দুই মাসে পর পর দুই বার গিয়ে আসলাম পার্বত্য জেলা বান্দরবান। প্রথম বার গিয়েছিলাম বান্দরবান শহর, নীলগিরি, চিম্বুক পাহাড়, শৈল প্রপাত, মিলনছড়ি ও বগালেক। দ্বিতীয় বার যাই নীলগিরি, শৈল প্রপাত, বগালেক ও ট্যুরের সবচেয়ে এক্সাইটিং পার্ট – কেওক্রাডং পাহাড়। কেওক্রাডং এর ট্রেকিং ও রাতে অবস্থানের সময় আমাদের সঙ্গী হয়েছিল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। স্মৃতিগুলো ধরে রাখার জন্য আর নয়নাভিরাম স্বর্গীয় দৃশ্যগুলোর সৌন্দর্য সকলের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে আজকের এই লেখার অবতারণা।
পথ চলা শুরু
প্রথমবার বান্দরবান যাই অক্টোবর ২০১৯ এ ঢাকা সিটি কলেজের CSE ডিপার্টমেন্টের কয়েক জন জুনিয়র-সিনিয়র সহ। সেই ট্যুরেই জানতে পারি পরের মাসে অফিস কলিগরা সহ আবার বান্দরবান আসবে। মূল আকর্ষণ কেওক্রাডং পাহাড়ে ট্রেকিং। আমরা ১২ জন অফিস কলিগ ৮ নভেম্বর ২০১৯ রাতে সেইন্ট মার্টিন পরিহবনের ইকোনমি ক্লাস এসি বাসে রওনা হই। ১২ জনের প্রায় সবাই মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপার। পান্থপথ থেকে বাসে ওঠার পর মনে হচ্ছিল পুরো বাসটাই যেন আমাদের। পরের দুই দিন ট্যুরের ধকল যাবে বেশ। তাই সবাই বাসে উঠেই ঘুমাবার আয়োজন করলাম। এসি বাস, তাই কম্বল দিয়েছে বাসের পক্ষ থেকেই। কিন্তু এমন দারুণ কম্বল! শরীরের ডান পাশ ঢাকলে বাম পাশ খুলে যায়, বাম পাশ ঢাকলে ডান পাশ উদোম। পা ঢাকলে কম্বল নেমে যায় বুকের নিচে, উপরের দিকে টানলে পা ফাঁকা হয়ে যায়। বেশ বুদ্ধি করে একটা কম্বলকে কেটে দুইটা বানিয়েছে বাস কর্তৃপক্ষ। ইকোনমি ক্লাস বলে কথা! কম্বলের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ হঠাৎ আবিষ্কার করি গাড়ি ব্রেক করলে আমরা সিট থেকে পিছলে সামনে চলে যাই! কী যন্ত্রণা! যতবার গাড়ি দ্রত গতি থেকে ব্রেক করে ততবারই সিটের রেগসিনের কারণে পিছলে যাচ্ছিলাম। ৩ বার সেইন্টমার্টিন পরিবহনে ওঠার অভিজ্ঞতা হয়েছে। সব বারই একই অবস্থা। তাই বুঝে নিলাম এটা আসলে তাদের বাসের একটা ফিচার, Not Bug!
কম্বল আর বাসের সিটের সাথে কসরত করতে করতে বাস এগিয়ে চলছিল। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটি সুপ্রশস্থ ও মসৃণ। নারায়নগঞ্জ পার হবার পর তেমন একটা জ্যামে পড়তে হয় নি। চট্টগ্রামের আশেপাশে থাকতে ফজরের ওয়াক্ত শুরু হল। ড্রাইভার সাহেব রাস্তার পাশের একটি সুন্দর মসজিদে নামাজের জন্য বিরতি নিলেন। নামাজ শেষে বাস আবার চলা শুরু করল। রাস্তার পাশে ফসলের ক্ষেত। দূরে কুয়াশার চাদর মুড়ে দাঁড়িয়ে আছে নাম না জানা অসংখ্য পাহাড়। পাহাড় আর গ্রামের উঁচু গাছপালা ডিঙিয়ে এক সময় আমাদের চোখে ধরা দিল কমলা রঙের সূর্য। বাস থেকে পূব আকাশের সূর্যোদয়টা ভালই লাগল। আস্তে আস্তে কুয়াশা কেটে গিয়ে আলো ছড়িয়ে পড়ছে। ভোরেই ফোনে কথা হল আমাদের কেওক্রাডং ট্রেকিংয়ের গাইড মোহাম্মদ আলী ভাইয়ের সাথে। তিনিই চান্দের গাড়ি ঠিক করে দিয়েছেন। কথা হল চান্দের গাড়ির ড্রাইভার আবদুল আজীজ ভাইয়ের সাথে। জানালেন আমরা বান্দরবান নামা মাত্র তিনি আমাদের নিয়ে ছুটবেন নীলগিরির পথে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল বান্দরবানের টুরিস্ট স্পটগুলোতে টেলিটক ও রবির নেটওয়ার্ক ভাল পাওয়া যায়।
নীলগিরির পথে
ট্যুর প্ল্যানের প্রথম দিন শনিবার তারিখ আমরা যাব নীলগিরি, শৈল প্রপাত, মিলনছড়ি এবং সবশেষে রুমা বাজার হয়ে বগালেক। বগালেকে রাত্রে থেকে পরদিন রবিবার সকালে যাব কেওক্রাডং পাহাড়ে। ঐ রাতটা পাহাড়ে থেকে সোমবার সকালে ফিরে আসব বগালেক। সেখান থেকে বান্দরবান শহরে। সোমবার রাতেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবার টিকেট আগে থেকেই কেটে রাখা হয়েছে।
বান্দরবান শহরে বাস থেকে নামতে প্রায় ৭টা বেজে গেল। যেহেতু বান্দরবান শহরে আমরা কোনো হোটেলে উঠব না তাই ফ্রেশ হতে হল বাসস্ট্যান্ডের পাশের পাবলিক টয়লেটে। যারা নিয়মিত ট্যুর দেন তারা তো বটেই, যারা ফ্যামিলি ট্যুর দিতে আসবেন তাদের জন্যও এটা খুব একটা খারাপ হবে না। মোটামুটি চালিয়ে নেয়ার মত টয়লেট আর হাতমুখ ধোয়ার ব্যবস্থা আছে। চান্দের গাড়িতে ওঠার আগেই নাস্তা করে নেয়ার সিদ্ধান্ত হল। নাস্তা করলাম কলাপাতা রেস্টুরেন্টে। ১২ জনের জন্য পরোটা বানাতে প্রায় আধা ঘন্টা সময় লাগবে। তাই রেডিমেড ডিম খিচুড়ি দিয়েই নাস্তা সারা হল। টুরিস্টরা সাধারণত খাবারের টেস্ট নিয়ে কোনো কমপ্লেইন করে না। ব্যক্তিগত ভাবে আমি আরো বেশি করি না। নুন-ঝাল এবং স্বাদহীন দেড় প্লেট খিচুড়ি খেয়ে শেষ করলাম। স্বাদহীন হলেও এই রেস্টুরেন্টের ডিম ভাজি আর খিচুড়ির জন্য আপনাকে গুণতে হবে ১০০ টাকা!
নাস্তা শেষে শুরু হল চান্দের গাড়িতে করে পাহাড়ী পথ বেয়ে ছুটে চলা। গাড়িটার নাম কেন চান্দের গাড়ি আল্লাহই জানেন। তবে আমি একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছি। এই গাড়ির চেহারা সুরত যাই হোক না কেন, যেমন ইঞ্জিন আর যেই শক্তি তাতে এই গাড়ি নিয়ে চান্দের দেশেও হয়ত যাওয়া যাবে। মঙ্গল গ্রহের পৃষ্ঠে বড় বড় খানাখন্দ আছে বলে জানা যায়। চাঁদেও কি সেরকম? চাঁদেও কি এবড়ো-থেবড়ো আমাদের মিরপুরের রাস্তার মত জমিন? যদি চাঁদেও এরকম খানাখন্দ থেকে থাকে তাহলে এই গাড়ি সেখানেও দিব্বি চলতে পারবে। কারণ পাহাড়ের রাস্তা, খানাখন্দ যেভাবে এটা পার হয়!
যাই হোক, বান্দরবান বা সাজেক ট্যুরের মূল আনন্দটা সম্ভবত চান্দের গাড়িতে করে পাহাড়ের গা বেয়ে আঁকাবাঁকা পথ পারি দেয়া। পাহাড়ের নিচ থেকে আপনি দেখতে পাবেন ঐ যে পাহাড়ের চূড়া, সেটাও উঠব। সেটা উঠতে গিয়ে কত বাঁক কত প্যাচগোচ পার হতে হয় তা নিজের চোখে দেখাটাই আনন্দ। পাহাড় বেয়ে উঠছি, হয়ত বাম পাশে খাড়া দেয়ালের মত পাহাড়ের গা। ডানে শত শত ফিট খাদ। দূরে দেখা যাচ্ছে সবুজ আলখেল্লায় আপাদমস্তক ঢেকে আছে অজস্র পাহাড় আর টিলা। যখন ভূমি থেকে আরো বেশ উপরে উঠে যাওয়া হয় তখন দেখা যায় সারি সারি পাহাড়ের মাঝে কিছু পাহাড় গাঢ় সবুজ মেশানো কালচে রঙের। তার পাশের পাহাড়েই দেখা যাবে হালকা সবুজ বা হলুদাভ রঙ। এই ছোপ ছোপ রঙের রহস্য কী? উপরে তালাকে দেখা যাবে কালচে সবুজ পাহাড়গুলোর ঠিক উপরের দিকেই রয়েছে এক খন্ড মেঘ। সেই মেঘের ছায়া পড়েছে ঘন সবুজ হয়ে থাকা পাহাড়ের উপরে। তার ঠিক পাশের হলুদাভ পাহাড়কে কোনো মেঘ আড়াল না করায় সূর্যের আলো সরাসরি পড়েছে। তাই সোনার মত চকচক করছে দূর থেকে পাহাড়ের গাছপালাগুলো।
আমাদের এখনকার লক্ষ্য নীলগিরি রিসোর্ট দেখা। এটা একটা পাহাড়ের চূড়ায় আর্মিদের তত্ত্বাবধানে তৈরি ও সাজানো গোছানো রিসোর্ট। সকাল ৯-১০টার মধ্যে এখানে আসতে পারলে মেঘের সুন্দর দৃশ্য দেখার সম্ভাবনা থাকে। মেঘ দেখার জন্য নীলগিরি, বগালেক, কেওক্রাডং বা এই অঞ্চলে ট্যুর দেয়ার জন্য অক্টোবর-নভেম্বর-ডিসেম্বর এই তিন মাস বেশ ভাল। বর্ষাকাল চলে যাবার পর এই সময়ে পেজা তুলার মত ছেড়া ছেড়া মেঘ দেখতে পাওয়া যায়। শরতের নীল আকাশে আপনার eye level এ মেঘ উড়বে। পাহাড়ের চূড়ায় বসে আছেন, সামনের গিরি খাদ থেকে এক গুচ্ছ মেঘ উপরে ওঠা শুরু করবে। বাতাসে আপনার দিকে এগিয়ে আসতে থাকবে। আপনি অনুভব করতে পারবেন যে আপনার শরীরে মেঘের কথাগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছে। অক্টোবরে যখন প্রথম নীলগিরি যাই তখন খুব সুন্দর দৃশ্য দেখতে পাই মেঘের। কিন্তু এইবারের ট্যুরের সময় বৃষ্টি হচ্ছিল। বুলবুল ঝড়ের জন্য শেষ পর্যন্ত মোংলা সমুদ্র বন্দরে ১০ নম্বর বিপদ সংকেত দেখানো হয়েছিল। ঝড়-বৃষ্টির প্রভাবে জমাট বাধা মেঘের দেখা এবার নীলগিরিতে পেলাম না। সব মেঘ বাতাসের জন্য এক সাথে হতে পারছিল না; ঘোলা হয়ে কুয়াশার মত হয়ে গেছিল। তাই ট্যুর প্ল্যান করার আগে একটু আবহাওয়ার আপডেট নিয়ে প্ল্যান করা ভাল। আমরা এই ট্যুরের প্ল্যান করেছিলাম প্রায় ১ মাস আগে। কারণ শুক্র-শনির সাথে লাগোয়া রবিবার সরকারি ছুটি ছিল। আবহাওয়া যাই হোক, মেনে নেয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
নীলগিরি যাবার পথে একটা জায়গায় এসে রাস্তা দুই দিকে চলে গেছে। যেই পথ ধরে আসছি সেই পথটার একটা শাখা চলে গেছে সোজা আরেকটা একটু নিচু হয়ে বাঁ দিক ঘেঁষে সোজা। দূর থেকে দেখলে অনেকটা ইংরেজি Y অক্ষরের মত একটা শেপ পাওয়া যায়। এজন্য এই জায়গাটার নাম ওয়াই (Y) জংশন। এখানে চান্দের গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির একটা এন্ট্রি করতে হয়। কতজন যাত্র, গাড়ির নাম্বার, ড্রাইভারের নাম ইত্যাদি তথ্য এখানে আর্মিরা এন্ট্রি করে নেয়। ফেরার সময়ও এখানে এন্ট্রি করে যেতে হয়। বান্দরবান বেড়াতে আসলে সাথে অবশ্যই ছবিযুক্ত আইডি কার্ড ও তার ফটোকপি নিয়ে আসবেন। নীলগিরি যাবার পথে আর্মিরা অনেক সময়ই আইডি কার্ড চেক করে।
ওয়াই জংশনের কাজ সেরে আবার যাত্রা শুরু। পাহাড়ের অপরুপ প্রকৃতি দেখতে দেখতে এক সময় এসে পৌঁছলাম নীলগিরিতে। নীলগিরিতে ঢুকার জন্য জন প্রতি ৬৫ টাকা করে টিকেট। আর চান্দের গাড়ির পার্কিং বাবদ রাখা হয় ৩০০ টাকা। যদিও গাড়ি পার্ক করা হয় রাস্তার উপর, তবুও আপনাকে টিকেট কাটার সময় এই টাকা গুণতে হবে। যানবাহন ভেদে পার্কিংয়ের খরচ ভিন্ন হয়। রিসোর্টের সামনে আছে অনেকগুলো টং দোকান। যেখানে পাওয়া যায় পাকা পেঁপে, আখ, কলা, জাম্বুরা, পাহাড়ি মরিচ ইত্যাদি। এখান থেকে এক রকম বলা চলে পেট ভরে পাকা পেঁপে খেলাম। ফালি করে কেটে রাখা পেঁপের দাম নিল ১০ টাকা করে।
সুন্দর সাজানো গোছানো পুরো রিসোর্টটি। বেশি সাজগোজের জন্য পুরোপুরি প্রাকৃতিক পরিবেশ বলা যাবে না একে। তবুও সব মিলিয়ে খারাপ না। বেশ কিছু বসার জায়গা আছের পাহাড়ের চূড়া ঘেষে। গুড টাইমিং হলে বসে বসে দেখতে পাবেন সামনে গিয়ে মেঘেদের ভেলা ভেসে চলেছে। আমি প্রথমবার নীলগিরিতে গিয়ে যেই বেঞ্চে বসেছিলাম তার সামনেই ছিল বিরাট একখন্ড মেঘ। বাতাসের সাথে দোল খেতে খেতে মেঘটা যেন আমাদের দিকেই আসতে থাকল। কিছুক্ষণ পর টের পাচ্ছিলাম হালকা মত ঠান্ডা কোনো বাতাস আমাদের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। আসলে সেগুলো ছিল মেঘের কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা।
বান্দরবানে যারা ফ্যামিলি ট্যুরে আসেন তাদের প্রথম আকর্ষণ থাকে এই নীলগিরি। পরিবার নিয়ে সময় কাটানোর জন্য খুব ভাল একটা জায়গা। রিসোর্টের বাইরে পাহাড়ী আদিবাসীদের টং দোকানে ফলমূল পাওয়া গেলেও রিসোর্টের ভিতরের রেস্টুরেন্টে খাবার-দাবার পাওয়া যায়। কেক, চিপস, বিস্কুট, আইসক্রিম সহ ফাস্টফুড আইটেম ও খিচুড়ি/বিরানিও পাওয়া যায় খুব সম্ভবত। রেস্টুরেন্টটা একদম পাহাড়ের গা ঘেষে তৈরি। জানালার পাশে বসে গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে চোখ জুড়াতে পারেন দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ পাহাড়। আর পাহাড়ের সাথে মিতালী গড়া মেঘ। এই দেখলেন কোনো মেঘ ভাব জমিয়েছে কোনো পাহাড়ের সাথে। আবার কী হলো! হঠাৎ ছুট দিল কোনো এক দিকে।
আর্মিদের ব্যবস্থাপনায় সব কিছু। তাই হয়ত পরিবেশ খানিকটা ভাল আছে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশই বলা যায়। এরপরেও এদিক ওদিক চকলেটের খোসা, চিপসের প্যাকেট পরে থাকতে দেখা যায়। জাতিগত ভাবে এখনো উন্নত না হবার প্রমাণ আমরা পদে পদে দিয়ে থাকি। রিসোর্টের ভিতরেই এক পাশে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য আলাদা ওয়াশরুমের ব্যবস্থা রয়েছে।
শৈল প্রপাতের শীতল পরশ
আমার প্রথম বান্দরবান ট্যুরে নীলগিরি থেকে ফেরার পথে শৈল প্রপাত ও চিম্বুক পাহাড়ে থেমেছিলাম। চিম্বুক পাহাড় বলার মত তেমন একটা প্লেস না। মনে হল অযথাই ২০ টাকা টিকেট কেটে টিলা সদৃশ পাহাড়ে উঠলাম। তবে তার তুলনায় শৈল প্রপাতটা ভাল লেগেছিল। ছোট্ট একটা ঝর্ণার মত নেমে এসেছে পাহাড়ের গা বেয়ে। বৃষ্টি হলে পানি বেশি থাকে। তখন আরো সুন্দর দেখায়। অনেকেই এখানে গোসল করে। আমাদের টিমের অনেকেই হাতমুখ ধুয়েছিল ঠান্ডা এই প্রপাতের পানি দিয়ে।
শৈল প্রপাতের পাশেই পাহাড়ীদের বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে থাকা চোখে পরবে। আমাদের টিমের অনেকেই এখান থেকে মোটা চাদর কিনেছিল। ৪০০-৪৫০ টাকা করে দাম পরে। এছাড়াও খেতে পাবেন জাম্বুরা, আনারস, পেপে, আখ সহ পাহাড়ী অন্যান্য কিছু আইটেম। নীলগিরি যাবার পথে বান্দরবান শহর থেকে শৈল প্রপাত হয়েই যেতে হয়। কিন্তু নীলগিরির সকালের সৌন্দর্য দেখার জন্য সাধারণ সবাই নীলগিরি যাবার পথে শৈল প্রপাত থামে না। ফেরার পথে শৈল প্রপাত হয়ে শহরে আসে। শৈল প্রপাত থেকে শহরে আসতে আধা ঘন্টার বেশি লাগার কথা না।
বগালেকের পথে আমরা
আমরা নীলগিরি থেকে নেমে রওনা হলাম বগালেকের উদ্দেশ্যে। আমাদের যেতে হবে আবার সেই ওয়াই জংশন। সেখান থেকে ওয়াই এর আরেক মাথা দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে রুমা বাজারের পথে। আমরা গাড়ি নিয়ে ওয়াই জংশন হয়ে নীলগিরির পথে ঢুকার সময় এন্ট্রি করেছিলাম। বের হবার সময়ও ড্রাইভার গিয়ে ক্যাম্পে বলে আসলেন যে সবাই ঠিকঠাক ব্যাক করছি।
পথ পাল্টে আমাদের পথ চলা শুরু হল রুমা বাজারের পথে। বগালেক যাওয়ার পথে ২-৩ টা আর্মি ক্যাম্পে থামতে হয়। গ্যারিসন নামের একটা জায়গায় আর্মিরা চাইলে ব্যাগ চেক করতে পারে। প্রথমবার আমাদের তেমন চেক হয় নাই। দ্বিতীয়বার যখন গিয়েছি সবার ব্যাগ এবং গাড়ি বেশ সময় নিয়েই তারা চেক করলেন।
আমার দ্বিতীয় বার বগালেকে যাবার সময় একটু তাড়াহুড়া করতে হয়েছিল। কারণ রুমা বাজার থেকে বিকাল ৩টার পর কোনো গাড়িকে বগালেকের দিকে যেতে দেয়া হয় না। তাই আমরা বেলা ১২টার মধ্যে নীলগিরি ত্যাগ করে রুমা বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলাম। রুমা বাজারে বেশ কিছু সময় লাগে ক্যাম্পে সবার নাম এন্ট্রি করতে।
নীলগিরির দিকে যাবার জন্য গাইড প্রয়োজন হয় না। কিন্তু বগালেক বা কেওক্রাডং যেতে হলে গাইড সাথে নেয়া বাধ্যতামূলক। আমরা আগে থেকেই গাইড আলী ভাইকে বুক করে রেখেছিলাম। রুমা বাজার নেমেই আমরা আমাদের সকল টিমমেটদের নাম-ধাম নির্দিষ্ট ফরমে লেখা শুরু করে দিলাম। প্রথমে বাজারের একটা দোকান থেকে ১০০ টাকা দিয়ে ফরম কিনতে হয়। সেখানে ১০ জনের নাম লিখা যায়। ১০ এর অধিক টুরিস্ট গ্রুপ হলে একাধিক ফরম কিনতে হয়। এখান থেকেই আপনি গাইড বুক করবেন। এরপর একটা প্রিন্টেড কাগজে নাম-ঠিকানা লিখে বন্ড সই দিতে হয়। সেখানে লেখা থাকে “আমি বগালেকে গিয়ে সেখানকার পানিতে নামব না। যদি নামি এবং কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তার জন্য অন্য কেউ দায়ী থাকবে না”। এরপর কিছু কাগজপত্র ফটোকপি করতে হয়। সেগুলো গাইড সব করবে যা যা দরকার। এরপর একটা উঁচু টিলার উপর অবস্থিত আর্মি ক্যাম্পে উঠে রেজিস্টার বইতে সকলের নাম, মোবাইল নাম্বার ইত্যাদি তথ্য লিখতে হয়। এসব প্রসেসিং করে ৩টার মধ্যে রুমা বাজার থেকে গাড়ি নিয়ে রওনা দেয়ার নিয়ম। এরপর গাড়ি ছাড়লে সন্ধ্যা হতে পারে এবং নিরাপত্তা জনিত সমস্যা হতে পারে। তাই আর্মি থেকে এটা কড়াকড়ি নিয়ম।
রুমা বাজার থেকে আমরা পেগাসাসের কিছু স্যান্ডেল কিনেছিলাম। কারণ বুলবুল ঝড়ের জন্য বৃষ্টি হচ্ছিল থেমে থেমে। পাহাড়ের উঁচু-নিচু পথ পিচ্ছিল হয়ে যাবে। দোকানদারের কথা ছিল “এই জুতা পইরা পিছলা খাইলে ট্যাকা ফেরত”। এই ভরসায় ১২০ টাকা দিয়ে এই বস্তু কিনলাম। এরপর আমি সফলতার সাথে ঢাল বেয়ে উঠতে গিয়ে একবার ভূপাতিত হলাম। আরেক টিমমেট শাফায়াত সফলতার সাথে মাত্র তিনবার ভূপাতিত হয়েছে। ফেরার পথে যেতে চেয়েছিলাম ঐ দোকানে। সময়ের অভাবে আর ১২০ টাকা করে ফেরত নেয়া সম্ভব হল না। পাহাড়ের জন্য সবচেয়ে ভাল হচ্ছে রাবারের সোল যুক্ত বেল্টওয়ালা স্যান্ডেল। আমরা বার্মিজ স্যান্ডেল বলি যেগুলোকে। বাটা বা অ্যাপেক্সে সহ নন ব্র্যান্ডেরও পাওয়া যায়। বাটায় সম্ভবত ৬০০-৭০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়।
রাত্রে বারবিকিউ করব। তাই গাইড আলী ভাই সহ গেলাম মুরগি কিনতে। ঢাকা থেকে কিছু মশলা আগে থেকেই নিয়েছিলাম। বাকিগুলো রুমা বাজার থেকে নিলাম। বেলা প্রায় তিনটা দুপুরের খাওয়া আমাদের তখনও হয় নাই। আলী ভাইকে দিয়ে বগালেকের যেই কটেজে থাকব তাদের ওখানে খাবার অর্ডার করে রাখলাম। বগালেকে খাওয়ার জন্য আগে থেকে অর্ডার দিতে হয়। অর্ডার পেলেই শুধুমাত্র তারা রান্নাবান্না করে। আর্মি ক্যাম্পের কাজ শেষ করে আমরা রওনা হলাম বগালেকের দিকে। পথে আরো কয়েক জায়গায় সবার নাম-ধাম লিখে সাইন করতে হল। পাহাড়ের পর পাহাড় পার হয়ে আমরা এগিয়ে চলছি প্রাচীনতম এই বগালেকের দিকে। গাড়ি কখনো উঠে যাচ্ছে প্রায় ৪৫ ডিগ্রি ঢাল বেয়ে খাড়া উপরের দিকে। আবার কখনো নেমে যাচ্ছে একই রকম খাড়া পথে। নামার পথে ব্রেকে পা কষে এরপর একটু একটু করে নামতে হচ্ছে। ব্রেক থেকে পা সরে গেলে বা ব্রেক ঠিক মত কাজ না করলে তাল হারিয়ে গাড়ি গড়িয়ে পরবে শত শত ফুট পাহাড়ের উপর থেকে একদম নিচে!
বেশির ভাগ রাস্তা ভাল হলেও মাঝে মাঝেই ভাঙা রাস্তাও আছে। চান্দের গাড়ি অবশ্য সেসব ভাঙা রাস্তাকে কোনো রকম সমীহ দেখিয়ে চলে না। চান্দের গাড়ি বলে কথা! একটা ফুল বডি ম্যাসাজের সার্ভিস নিতে নিতে আপনি এগিয়ে যাবেন। এই রকম উঁচু-নিচু ওঠা-নামা অনেকের সহ্য হয় না। অনেকে বমি করে দেয়। আর বসতেও হয় এই গাড়িতে লেগুনার মত করে। তাই কয়েক ঘন্টা এভাবে বসে থাকলে মাথা খানিকটা এমনিতেই ঘুরে। কারো এমন সমস্যা থাকলে কিছু সময়ের জন্য ড্রাইভারের পাশের সিটে বসা যেতে পারে। আর মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে খোলা ছাদ দিয়ে মাথা বের করে বুক ভরে পাহাড়ী অক্সিজেন নিলেও খানিকটা ভাল লাগবে।
বিকালে বিকালে আমরা পৌঁছে গেলাম বগালেক। হাতমুখ ধুয়েই ঝাপিয়ে পড়লাম ভাতের উপর। আলু ভর্তা, হলুদ পাতা আর হলুদ ফুলের ভর্তা, ডিম ভাজা আর ডাল। সবাই গোগ্রাসে অমৃতের মত করে পেটে চালান করতে লাগল জুমের চালের গরম ধোয়া ওঠা ভাত। খাবারের প্রকৃত স্বাদ আসলে পাওয়া যায় যে কোনো কষ্টকর ট্যুরে। তাই শুধু ডাল আর ভাতের মধ্যে যে আল্লাহ কত স্বাদ আর আনন্দ দিয়েছেন সেটা বুঝার জন্য হলেও ট্যুর দেয়া উচিত। যেই ছেলেটি জীবনে কখনো শুটকি ছুঁয়ে দেখে নাই, তাকে দেখেছি এই ট্যুরে এসে আগুন ঝাল শুটকি দিয়ে খেতে আর তার প্রসংশাও করতে। একটা লেখায় দেখেছিলাম ৬-৭ বছরের বাচ্চারা গড়ে ৩০০ বার হাসে প্রতিদিন। বড়রা সেখানে ১০-১৫ বার। লেখক বলছিলেন ৬ বছর বয়সে ফিরে যাবার চেষ্টা করতে। ট্যুর এমন একটা মাধ্যম, যেখানে সকলের বাচ্চামীগুলো প্রকাশিত হয়। শিশু সুলভ আচরণগুলো অবলীলায় সবার মধ্যে স্বতস্ফূর্ত ভাবে ছড়িয়ে যায়। একটুও ন্যাকামো মনে হয় না কারো কাছে। ছোট থেকে ছোট বিষয়েও হেসে লুটোপুটি হবার জোগাড় হয় ট্যুরগুলোতে। এই বান্দরবান ট্যুরও এর ব্যতিক্রম নয়।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আসরের ওয়াক্তে যুহর আর আসরের নামাজ একত্রে (জমা) পড়লাম। আপনি নিশ্চয়ই জানেন সফরের সময় যুহর ও আসরের নামাজ একত্রে যুহরের ওয়াক্তে বা আসরের ওয়াক্তে পড়া যায়। অর্থাৎ যুহরের সময়েই ঐ দিনের যুহরের নামাজ আর আসরের নামাজ পড়া যায়। একই ভাবে আসরের সময় যুহর ও আসর একত্রে পড়া যায়। একই ভাবে মাগরিব ও ইশার নামাজ মাগরিবের ওয়াক্তে বা ইশার ওয়াক্তে পড়া যায়। সফরকারীদের সুবিধার জন্য আল্লাহ উক্ত নিয়মে কসর পড়ার (চার রাকাত ফরজের পরিবর্তে দুই রাকাত পড়া) অনুমতি দিয়েছেন। আমরা আসরের ওয়াক্তে যুহর আসর পড়ে বিস্রাম নিলাম। এরপর মাগরিব-ইশা একত্রে পড়ে কটেজ থেকে বের হলাম। বাইরে বুলবুল ঝড়ের প্রভাবে থেমে থেমে বৃষ্টি আর বাতাস পাচ্ছিলাম। এই গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মধ্যেই আমাদের গাইড আলী ভাই ইট দিয়ে ঘিরে কাঠের লাকড়ি সাজালেন। তাতে আগুন দিয়ে আমরা হালকা শীত শীত পরিবেশে আগুন পোহাচ্ছিলাম।
কাঠ পুড়ে কয়লা হবে। এরপর গনগনে কয়লার আগুনে পোড়ানো হবে মেরিনেট করে রাখা চিকেন। আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। এর পাশেই মোবাইল চার্জ দেয়ার ঘর। কটেজগুলোতে সৌরবিদ্যুতে একটা বাল্ব জ্বলে। মোবাইল চার্জ দেয়ার জন্য এই ঘরে আসতে হয়। জেনারেটর চালিয়ে মোবাইল চার্জ দেয়ার ব্যবস্থা। মোবাইল চার্জ করার জন্য গুণতে হয়েছিল ৩০ টাকা। পাওয়ার ব্যাংকের জন্য নেয় ৫০ টাকা। কাঠ পোড়া মোটামুটি শেষ হল। এই কাঠ নেয়া হয়েছিল আমরা যেই কটেজে থাকব তার কাছ থেকে। লাকড়ি বাবদ ২০০ টাকা খরচ করতে হয়েছে। কাঠের অগ্নিশিখা কমে এলে আলী ভাই ঐ কটেজের বৌদীর থেকেই লোহার নেট নিয়ে আসলেন। ইট বিছিয়ে তার উপর লোহার নেট বসিয়ে দিয়ে তার উপর বসিয়ে দেয়া হল পিস করে কাটা চিকেন। মৃদু পটপট শব্দে পোড়া হতে থাকল মুরগি। বারবিকিউ মশলার সাথে মুরগির মাংসের পোড়া ঘ্রাণে চারিদিক ম ম করছিল।
প্রথমে এক দফা পোড়ানোর পর আলী ভাই চিকেনগুলো তুলে আবার বারবিকিউ সসে ডুবালেন। এরপর আবার ছাড়া হল কয়লার কাঁচে। তাতে চিকেনে মশলা আরো ভাল ভাবে ঢুকে আরও বেশি স্পাইসি আর টেস্টি হয়। লবণ চাখার নাম করে আগুণের থেকে উঠিয়ে খানিকটা মাংস পেটে চালান করে দিতে ভুল হল না। চারটা মুরগিতে ১৬ পিস হল। আমরা ১২ জনের টিম আর সাথে গাড়ির ড্রাইভার ও গাইড। ১৪ জন বসে পড়লাম লারাম বৌদীর বাড়ির সামনের খাবার জায়গায়। মিনিট পাঁচেকের বেশি চিকেনের অস্তিত্ব আমাদের সামনে আর রইল না। সবার খাওয়া শেষ! এ ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন “এইটুকই?” এত মজার বারবিকিউ আসলে কমই খাওয়া হয়েছে। মজা যতটা না রান্নার গুণে, তার চেয়ে বেশি পরিবেশের গুণে। আলী ভাইয়ের রান্নার হাত মাশাআল্লাহ! উনারা যখন গহীন বনে ট্রেকিংয়ে যান তখন সব রান্না বান্না উনাকেই করতে হয়। ভাত থেকে শুরু করে সব কিছু উনি বাঁশের ভিতরেই রান্না করে ফেলেন।
বারবিকিউ পার্টির পর আমরা গিয়ে বসলাম কটেজের বারান্দায়। আধো আলো ছায়ায় আবছা লেক দেখা যাচ্ছে। গাইড আলী ভাই একের পর এক গান শোনালেন। কোনোটা পরিচিত পাহাড়ী গান। কোনোটা তাদের একদম স্থানীয় গান। গানের শব্দে শব্দে গুঞ্জরিত হচ্ছে যেন কোনো বিরহীর বিষাদময় দীর্ঘশ্বাস। আশেপাশের কটেজ থেকেও পরিচিত-অপরিচিত গানের সুর ভেসে আসছে। সাথে আছে নাম না জানা পাহাড়ী পোকা-মাকড়ের ডাকাডাকি।
বগালেকে রাত্রি যাপনের ক্ষেত্রে আর্মির নির্দেশনা হচ্ছে রাত ১০ টা পর্যন্ত গানবাজনা হৈ হুল্লোড় করা যাবে। আমরা এর আগেই গানবাজনা বন্ধ করে খেতে গেলাম। প্রায় দুই-তিন সপ্তাহ আগেই আলী ভাইয়ের মাধ্যমে বন মোরগের অর্ডার দিয়ে রেখেছিলাম। রাতের খাবারে চলল সেই বন মোরগ আর ভর্তা, সবজি, ডাল। প্রতিটা আইটেমের স্বাদই মুখে লেগে থাকার মত। এখানের চালগুলো আমাদের মত না। সব চালই জুম চাষের চাল। একটু মোটা আর আঠালো প্রকৃতির। সুন্দর একটা ঘ্রাণ আছে ধোয়া ওঠা গরম ভাতের। এখানে খেয়েছিলাম হলুদ ফুলের ভর্তা। বেশ লেগেছিল!
রাতেই আলোচনা হল যে ঝড়-বৃষ্টির আশংকা আছে। তাই পরদিন সকালে ১২ জনের মধ্যে ৮ জন ব্যাক করবে বান্দরবান শহরে। আর আমরা চার জন যাব কেওক্রাডং পাহাড়ে। যদি ঝড় বৃষ্টির পরিমাণ খুব বেশি হয় তাহলে আমরা চারজনও ফিরে যাব বান্দরবান। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর আমি সহ আর ২-১ জন ঘুমিয়ে পড়লাম। আমার এমনিতেই রাত ১১টায় ঘুমাবার অভ্যাস। এর উপর সারাদিনের ধকল। বাকিরা বসলেন ভুতের গল্প করতে। এক পাশে বগালেকের ঠান্ডা শীতল বাতাস। হালকা চাঁদের আলো মাঝে মাঝে মেঘ ভেদ করে এসে পড়ছে। এর মধ্যে “তেনাদের” গল্প মিস করাটা আসলে বিরাট মিস! যাই হোক, এক ঘুমে রাত পার করে দিয়ে সকালে বের হলাম আশেপাশে ঘুরে দেখতে।
নাস্তা করে সবাই গোছগাছ শুরু করতে লাগলাম। মাঝেমাঝে রোদের দেখা পেলেও ভয় ভয় করছিল পথের কথা চিন্তা করে। অ্যাপে দেখাচ্ছিল ঘুর্ণিঝড় বুলবুল আমাদের আশেপাশেই আছেন। তাও আল্লাহর নাম নিয়ে আমি, শাফায়াত, আকাশ ও রনি ভাই (সবাই ব্রেইন স্টেশন ২৩ এর অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ ডেভেলপার) আমরা চারজন রওনা হলাম গাইড আলী ভাইকে নিয়ে। বাকিরা আরেকজন গাইডকে সাথে করে রওনা হলেন বান্দরবান শহরে। আমাদের প্ল্যান হল আজকের রাতটা কেওক্রাডংয়ে থেকে পরদিন সকালে বগালেকে ফিরে আসব। সেখান থেকে দুপুরের মধ্যে বান্দরবান। রাতের বাসে ঢাকা।
কেক্রাডংয়ের পথে ট্রেকিং শুরু
আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম চারজনের জন্য ব্যাগ হবে একটা। বাকি ব্যাগ-ব্যাগেজ আমরা বগালেকের কটেজে রেখে যাব। এক রাতের জন্য যেই সব জিনিস না নিলেই নয় এমন কাপড়-চোপড় নিয়ে ব্যাগ বাঁধলেন অভিজ্ঞ ট্রেকার রফিকুল হাসান রনি ভাই। এই নিয়ে রনি ভাইয়ের কেওক্রাডংয়ের তৃতীয় বার আসা। ঘুরে এসেছেন সান্দাকফু থেকে। সর্বোচ্চ ১৫,০০০ ফিট উচ্চতার পাহাড়ে ট্রেকিং করেছেন। অভিজ্ঞ হাতে তিনি দেখালেন কিভাবে ট্রেকিংয়ের জন্য ব্যাগ প্যাক করতে হয়। ব্যাগটা ঝুলিয়ে দেয়া হল আকাশের কাঁধে। আকাশের সাইনোসাইটিস আর অ্যাজমার সমস্যা ছিল। তাই শুরুতে ওকে যতটুকু খাটানো যায়। পরের দিকে আর ওকে দিয়ে ব্যাগ টানানো হবে না। তাই রনি ভাইয়ের এই সিদ্ধান্ত।
কেওক্রাডংয়ের জন্য রওনা দেয়ার আগে বগা লেকের আর্মি ক্যাম্পে এসে আবার নামধাম লিখে সাক্ষর করতে হয়। আবার কেওক্রাডংয়ে পৌঁছেও ওখানকার আর্মি ক্যাম্পে নাম-ধাম লিখতে হয়। ফেরার পথেও সাক্ষর করে ফিরতে হয় সবগুলো জায়গায়, যত জায়গায় প্রবেশের পথে সাক্ষর করে আসতে হয়েছে।
কেওক্রাডং বাংলাদেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। এক সময় একে দেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হিসাবে ধরা হত। সর্বশেষ জানা যায় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ সাকা হাফং। কেওক্রাডংয়ের উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৩২৩৫ ফুট। আর সাকা হাফংয়ের উচ্চতা ৩৪৬১ ফুটের মত। আধুনিক সময়ে পাহাড়ের উচ্চতা মাপা হয় GPS টেকনোলজির সাহায্যে। এর আগের সময়ে ত্রিকোণমিতির হিসাবনিকাশ করে পাহাড়ের উচ্চতা বের করা হত। মনে আছে না নাইন-টেনের সেই বাঁশের খুটির ছায়ার দৈর্ঘ্য আর কোণের মাধ্যমে খুটির উচ্চতা মাপার অংক?
বগালেক থেকে কেওক্রাডংয়ের চূড়া পর্যন্ত যেতে আপনাকে পার হতে হবে মোটামুটি ৮ কিলোমিটার রাস্তা। সমতলের ৮ আর পাহাড়ের ৮ কিলোমিটারের মধ্যে পার্থক্য আছে কিন্তু! আর সাথে যদি থাকে আমাদের মত ঝড়বৃষ্টি তাহলে তো সোনায় সোহাগা! তাই পিঠের ব্যাগের ওজন যতটা কমানো যায় তত ভাল। পায়ে রাবারের সোলযুক্ত পিছনে বেল্টওয়ালা স্যান্ডেল এবং মোটা মোজা থাকলে ভাল। কারণ চলতি পথে আপনার পায়ের সাথে স্নেহের স্পর্শে জড়িয়ে পরতে পারে জোঁক! তেনাদের সংস্পর্শ এড়ানোর জন্য মোটা মোজা পরা যেতে পারে। পথ চলতে সুবিধার জন্য বাঁশ নিতে পারেন বগালেক থেকে। গাইডই আপনাকে বলে দিবে কখন কী নিতে হবে।
আমরা যেই দিন পাহাড়ে উঠছি তার আগের রাতে কেওক্রাডংয়ে প্রায় আড়াইশ পর্যটক ছিলেন বলে জানতে পারলাম। পাহাড়ে উঠার জন্য আমরা খুব বেশি পর্যটক ঐদিন দেখলাম না। দলে দলে সবাইকে নামতে দেখলাম। মনে মনে খুশিই হলাম। পাহাড়ে হৈ-হুল্লোড় কম থাকবে। আগের রাতে বৃষ্টি আর এতজন পর্যটকের নেমে আসার জন্য পুরো পথটাই হয়ে ছিল পিচ্ছিল আর কর্দমাক্ত। আমরা উঠার সময় তেমন কষ্ট না হলেও যারা নামছিলেন তাদের জন্য এই পিচ্ছিল পথ ধরে নিরাপদে নেমে আসা খুব কঠিন ছিল। অনেক আপুদের দেখছিলাম এক রকম কান্নাকাটি শুরু করতে। কারণ বাই চান্স পা একটু স্লিপ করলেই পিছলে নিচের খাদে! এদের মধ্যে কাউকে কাউকে দেখা গেল ট্রেকিং করতে এসেছেন হাই হিল পরে! সম্ভবত উনারা প্রো লেভেলের ট্রেকার। তাই কোনো পরোয়া করেন না!
ঘন্টাখানেক বা আরো কম সময়ে সম্ভবত আমরা পৌঁছে গেলাম চিংড়ি ঝর্ণায়। শুনেছিলাম এখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে জোঁক আছে। তাই ইচ্ছা ছিল ঝর্ণা এড়ানোর। পরে আর তা এড়াতে পারি নাই। যত দূর পারা যায় ঝর্ণার কাছাকাছি গিয়েছিলাম। অনেক টুরিস্ট গ্রুপ দেখলাম শুধু ঝর্ণা দেখতেই এখানে এসেছে। আমরা যেমন পাহাড়ে উঠার পথে ঝর্ণা দেখছি উনারা শুধু ঝর্ণা দেখতেই এসেছেন। ঝর্ণাটা বেশ সুন্দর। এর টলটলে ঠান্ডা পানি ইচ্ছা মত পান করে আর হাফ লিটারের বোতলে ভরে নিয়ে গেলাম। গাইড মারফত জানতে পারলাম বগা লেকের কটেজগুলোর আর আদীবাসিদের যাবতীয় পানির চাহিদা মেটে এখান থেকে। এই ঝর্ণা প্রবাহিত হবার পথে একটা লোহার পাইপ বসানো দেখা গেল। সেই পাইপ চলে গেছে সেই বগালেক। যেহেতু ঝর্ণার জায়গাটা থেকে বগালেক বেশ নিচে তাই কোনো মোটর বা আলাদা পাওয়ার ছাড়াই বগালেকে পানি পৌঁছে যায়।
চিংড়ি ঝর্ণা ক্রস করে সামনে এগুনোর সময় গাইড আলী ভাই বললেন রেইন কোট পরে নিতে। ভাল বৃষ্টি শুরু হচ্ছিল। পরে দেখা গেল এই বৃষ্টি, এই রোদ। আর রেইন কোট পরে হাঁটায় কষ্টও বেশি। তাই বাদ দিলাম রেইন কোট। এক পর্যায়ে সামনে আসল লাল মাটির খাড়া একটা ঢাল। আমাদের চার জনের মধ্যে শাফায়াত হচ্ছে দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে সবচেয়ে বড়। ধাপ-ধুপ করে মোটামুটি সে তিন দফা আছাড় খেল। আমি সাবধানে উঠতে থাকলেও শেষ রক্ষা হল না। পা দেখলাম ক্রমাগত পিছলে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে উপুর হয়ে আধশোয়া অবস্থায় চলে গেলাম নড়াচড়া বাদ দিয়ে। যেন মাটির সাথে শরীরের বেশির ভাগ অংশ লেগে ঘর্ষণের ফলে খানিকটা গ্রিপ বেশি পাই। পরে আলী ভাই এসে টেনে রাস্তার পাশের জঙ্গলের উপর নিয়ে আসল। পাহাড় পিছলে নিয়ে গড়িয়ে পরার চেয়ে জোঁকের কামড় ঢের ভাল! এই চিন্তা করে খাড়া পথটা জংলী গাছপালার উপর দিয়ে পার হলাম। ওদিকে রনি ভাই আমাদের ২ জনকে উদ্ধারে সাহায্য করে আরেকটা টিম যারা পাহাড় থেকে নেমে আসছেন তাদেরকে হেল্প করছিলেন নামতে। উনি একে প্রো লেভেলের ট্রেকার, তার উপরে উনার জুতার রাবারের সোলের সেই রকম গ্রিপ! উনি পুরো পথ লাঠির হেল্প ছাড়াই কাদার মধ্যে হেঁটে এসেছেন। ঐ টিমকে সাপোর্ট দিয়ে উনি ফেরার পথে হঠাৎ পা পিছলে পরলেন! প্রায় ত্রিশ ফুট ঢাল বেশে উনি স্লাইড করলেন! ছোট বেলায় অনেকে মাটির উঁচু ঢিবি থেকে বৃষ্টির সময় বসে পিছলা খেয়ে নামত। সেরকম করে উনি গড়িয়ে গেলেন! আল্লাহর রহমত যে খাড়া পথটার দূরত্ব বেশ লম্বা ছিল। ফলে পথ পার হয়ে পাহাড়ের খাদে পরে যাওয়ার মত সিচুয়েশন হয় নাই। পরে নিজেই উঠে আবার আমাদের কাছে পৌঁছে গেলেন।
আরো কিছুদূর এগুবার পর পাহাড়ীদের একটা পাড়ার কাছে পৌঁছলাম। সেখানে ২-১ টা টং দোকান থেকে লেবুর শরবত, পেঁপে খেলাম। পাহাড়ী এক মুরুব্বি আমাদের গাইডকে তার আঞ্চলিক ভাষায় বললেন দ্রুত আমাদের রওনা দিতে। আকাশের অবস্থা ভাল না। ঝড় আসবে। আমরা আবার পা চালালাম কেওক্রাডংয়ের দিকে।
বগালেক থেকে কেওক্রাডং যাবার পথে অনেকগুলো পাহাড় পার হতে হয়। কোনোটার নাম আছে। কোনোটা আবার বেনামী। কিছুদূর পাওয়া যায় সমতল ভূমি। এরপর খাড়া নিচের দিকে। মানে কোনো একটা টিলা বা পাহাড় বেয়ে নামতে হচ্ছে। আবার দেখা যাবে খাড়া উপরে উঠতে হচ্ছে। এভাবে একের পর এক পাহাড় ডিঙ্গিয়ে পেচানো পেচানো পাহাড়ী পথ বেয়ে উঠে যেতে হয় চূড়ায়। কোনো শর্ট কাট নেই। যেন একদম সফলতার মত। সফল হবার যেমন কোনো শর্টকাট নাই। একই রকম ভাবে পাহাড়ে ওঠারও কোনো শর্টকাট নাই। আপনার স্ট্যামিনা, আপনার ধৈর্য্য, আপনার শক্তি, আপনার সহিঞ্চুতা সকল কিছুর পরীক্ষা একসাথে দিতে পারবেন পাহাড়ে আসলে। ট্রেকিংয়ের সময় পানির পিপাসা বেশি লাগবে। আবার ওজনের জন্য বেশি পানি নিয়েও হাঁটতে চাইবেন না। পথে ২-৩ টার বেশি ঝর্ণা পাওয়া যাবে না। ঝর্ণা পেলে ইচ্ছা মত পানি খেয়ে হয়ত হাফ লিটার সাথে নিলেন। অল্প অল্প করে খেতে হবে যেন পরের ঝর্ণা পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন কষ্ট করা ছাড়াই। যদিও কেওক্রাডংয়ের ট্রেকিং হিসাবে খুবই কম সময়ের। বগালেক থেকে সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টায় পৌঁছানো যায় কেওক্রাডংয়ে। আরো বড় পাহাড়ের পরীক্ষাগুলো হয়ত আরো বেশি উপভোগ্য।
আর তেমন কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই আল্লাহর রহমতে বৃষ্টি মাথায় করে এসে পৌঁছলাম দার্জিলিং পাড়ায়। এটা পাহাড়ী আদিবাসীদের একটা পাড়া। এখান থেকে অপর পাশের পাহাড়ের দৃশ্য দেখতে অনেকটা দার্জিলিংয়ের মত লাগে। তাই এমন নামকরণ। জামা-কাপড়, পা সর্বত্র কাদায় মাখামাখি। প্রচন্ড ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে বসে পড়লাম ওখানকার একটা দোকানে। বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি পরছে। পাঁচ জনে মিলে বিস্কুট-কেক খেয়ে প্রায় শ তিনেক টাকা বিল উঠিয়ে আবার রওনা হলাম আমাদের মূল গন্তব্যের দিকে। দার্জিলিং পাড়া থেকে কেওক্রাডং উঠতে ৪৫ থেকে ৫০ মিনিটের মত লাগতে পারে। বেশ কাছেই। এই বেলা দার্জিলিং পাড়া নিয়ে তেমন কিছুই লিখলাম না। ফেরার পথে কিছু লেখা যাবে।
স্বপ্নের কেওক্রাডং!!!
দার্জিলিংপাড়া পার হয়ে ৩০-৪০ মিনিট হাঁটার পর আস্তে আস্তে অনুভূত হচ্ছিল চলে এসেছি গন্তব্যে। দুপুর আড়াইটা বা তিনটার দিকে পৌঁছলাম কেওক্রাডংয়ের চূড়ায়। বৃষ্টি-কাদার জন্য আস্তে আস্তে পথ চলতে হয়েছিল। আর সাথের এক টিমমেটের শ্বাসকষ্টের জন্য বেশি বেশি রেস্ট নেয়া হয়েছে। ফলে বাকি সবার জন্যেই পুরো ট্রেকিংটা বেশ স্ট্রেসলেস ছিল। কেওক্রাডংয়ে পৌঁছে আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে নাম এন্ট্রি করতে হল। এরপর হাত-মুখ ধুয়ে বসে পরলাম দুপুরের খাবার খেতে।
আমরা যখন কেওক্রাডংয়ে পৌঁছলাম তখন বেশ ঝড়ো হাওয়া বইছিল। বাতাসের ঝাপটায় পাহাড়ের চারিধারের মেঘ ভেঙেচুরে একাকার অবস্থা। তখন আর ওগুলোর চেহারা মেঘের মত নাই। হয়ে গেছে কুয়াশার মত। উপরের ছবিতে পিছনে সাদা দেখা যাচ্ছে। সবই জটলা পাকানো মেঘের কণা। যেমন বাতাস, তেমনই ঠান্ডা। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন ছিল বাতাসের দাপটে। সাধারণত এরকম বাতাস থাকে না। ঐদিন ঘুর্ণিঝড় বুলবুলের জন্য ৯ বা ১০ নম্বর বিপদ সংকেত চলছিল। টিশার্ট পরে বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। পরে শীত নিবারণের জন্য রেইনকোট পরে থাকতে হল।
আর্মি ক্যাম্প থেকে বলে দিল বিকালে একটা নির্দিষ্ট সময় পাহাড়ের একমাত্র হোটেলটিতে উপস্থিত হতে। কটেজে গিয়ে রেস্ট নিয়ে উঠে ঐ সময়ে উপস্থিত হতে হল। সেখানে কয়েক লাইনে হালকা পাতলা হুঁশিয়ারি দিল যেন কেউ এখানে ‘নেশা-পানি’ না করেন। এরপর কটেজে ফিরে এসে সন্ধ্যায় পাশের রুমের টুরিস্টদের আমন্ত্রণে জাম্বুরা খেতে গেলাম। প্রায় ঘন্টা খানেক তাদের সাথে আড্ডা চলল। দেখা গেল ঐ টিমেরও প্রায় সবাই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার বা সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রির সাথে যুক্ত। এর মধ্যে আবার একজনকে পেলাম যিনি আমার ব্লগের একজন পুরনো পাঠক! 😛
পাহাড়ে ঐ রাতে আমরা ২৫-৩০ জনের বেশি ছিলাম না। সবাই মোটামুটি ঝড়ের জন্য ভয়ে ছিলাম। নেট ঘেটে জানা গেল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল সাহেব তার গতিপথ পরিবর্তন করে এখন বান্দরবান এসেছেন! ভয়ের মাত্রা আরো বেড়ে গেল। রাতে আর পরদিন বৃষ্টি হলে পিছলা পথ ধরে নামব কিভাবে সেই চিন্তা করে অস্থির বোধ করছিলাম। আর সারা দিনে পাহাড়ের উপর থেকে মেঘের কোনো ভিউ দেখা যায় নাই আউলা ঝাউলা বাতাসের জন্য। পরের দিনও আবহাওয়া এমন থাকলে আর ভিউ পাওয়ার আশা নাই। রনি ভাই আগে দুইবার এসেছিলেন। দুইবারই ঝড়ের সময় এসেছেন। এই তৃতীয়বার এসেও উনার ভিউ মিস করতে হবে। উনি মিনমিন করে বলছিলেন “ইশ! যদি আরেকটা রাত থেকে যেতে পারতাম!!! তাহলে ঝড়টা কেটে যেত। পরের দিন হয়ত মেঘের ভিউ দেখতে পেতাম!” তার বলা মাত্র বাকি তিন জন এক বাক্যে রাজি!!! এদিকে আগামীকাল সোমবার রাতে আমাদের ঢাকা ফেরার টিকেট কাটা হয়ে আছে। বান্দরবান শহরে আমাদের অপর ৮ জন টিমমেট অবস্থান করছে। এসি বাসের টিকেট রিটার্ন করা যাবে কিনা সিওর না। সবাই রাজি হলাম প্রয়োজনে টিকেটের টাকা গচ্চা দিব। মঙ্গলবার পর্যন্ত ছুটি নেয়া ছিল। লাগলে মঙ্গলবার রাতে রওনা হয়ে বুধবার ঢাকায় নেমেই অফিসে দৌঁড়াব। রেস্ট দরকার নাই। যেই ভাবা সেই কাজ! গাইডকে জানিয়ে দিলাম আমরা আরেক দিন বেশি থাকব এখানে। উনি বললেন টুরিস্ট ফরমে ফেরার তারিখ উনি বুদ্ধি করে একদিন পরের তারিখ লিখেছেন। অর্থাৎ আমাদের আগের প্ল্যানে যতদিন থাকার কথা ছিল তার সাথে একদিন বাড়িয়ে উনি ফরম ফিলাপ করেছেন। এটা না করা থাকলে নাকি আমরা চাইলেও পাহাড়ে আরেক রাত থাকতে পারতাম না। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই আমাদেরকে বের হয়ে আসতে হত। তাই আপনারাও চাইলে ট্যুরের সময়ের সাথে ২-১ দিন যোগ করে ফরম ফিলাপ করে রাখতে পারেন।
আমাদের গাইড মোহাম্মদ আলী ভাইয়ের কন্ঠে গাওয়া গান
এদিকে শাফায়াতের অবস্থা খারাপের দিকে। সে সফলতার সাথে তিনবার আছাড় খেয়ে তিনবারই নাকি হাতের জয়েন্ট ডিসপ্লেস হয়েছে। ব্যথায় নাকি খুব কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কথাবার্তায় বুঝাও যাচ্ছে না। হোটেলে টিভি দেখতে আসা একজন সেনা সদস্যের সাথে কথা বললাম ক্যাম্পে ডাক্তার বা ওষুধ আছে কিনা। পাশ থেকে অন্য একটা টিমের একজন গাইড বললেন তার টিমে তিনজন টুরিস্ট আছেন ডাক্তার। লৌহমানব শাফায়াতকে নিয়ে গেলাম ডাক্তারের কাছে। সে যেই স্পিডে কথা বলে ডাক্তারের বুঝার কথা না। আবার অনুবাদ করে দিতে হবে। তাই আমিই বললাম যে হাত খুলে আসছিল। ডাক্তার বললেন কেমনে বুঝলেন হাত খুলে আসছিল? জয়েন্ট খুলে আসলে তো উনি এখনো দাঁড়ায় থাকতে পারতেন না। শাফায়াতকে জিজ্ঞেস করা হল ব্যথা কেমন? শাফায়াত হাসতে হাসতে বলে প্রচন্ড ব্যথা! ডাক্তার হাসি দেখে কনফিউজড! এরপর যোগ করে ব্যথায় নিশ্বাঃস বন্ধ হয়ে আসতেছে একটু পরপর। পরে ইনস্ট্যান্ট পেইন কিলার আর গ্যাসের ওষুধ লিখে দিলেন। আর বললেন ঢাকায় এসে ডাক্তার দেখিয়ে প্রয়োজনে এক্সরে করতে। পেইন কিলার পাওয়া গেল আর্মি ক্যাম্পে। আর সেই ডাক্তার টিমের সেই গাইড দিলেন গ্যাসের ওষুধ।
যেহেতু সকালে পাহাড় ত্যাগ করার তাড়া নাই তাই প্ল্যান হল নাস্তা সেরে দার্জিলিংপাড়ায় যাব। আর্মি ক্যাম্প থেকে বলে দিল দুপুর ২ টার মধ্যে পাহাড়ে ব্যাক করতে হবে। ঠিক হল ২টার মধ্যে ফিরে এসে ওযু-গোসল সেরে পাহাড়ের হোটেলেই দুপুরের খাবার খাব। বগালেকের মত কেওক্রাডংয়েও আগে থেকে জানিয়ে রাখতে হয় কয়জন খাব আর কী খাব। ইনস্ট্যান্ট গিয়ে সাধারণত খাবার পাওয়া যায় না।
কেওক্রাডংয়ে দ্বিতীয় রাতে যখন আমরা আছি আমাদের সাথে খুব বেশি হলে আর ৬-৭ জন টুরিস্ট আছেন পুরো পাহাড়ে। পাহাড়ের ঐ রাতটা ছিল মনে রাখার মত। এত্ত বড় একটা কাসার থালার মত চাঁদ উঠল। পরিষ্কার আকাশ। হাজার হাজার তারা। চাঁদ আর মেঘদের লুকোচুরি পরিবেশকে অন্যরকম একটা মাত্রা এনে দিয়েছে। আগের রাতের মত ঝড়ো হাওয়া আর নাই। রাত শেষে পরদিন ভোর যেদিন আমরা চলে যাব সেই ভোরটাও ছিল অসাধারণ। আমরা একটা রাত বেশি থেকে যাওয়াও অর্জনগুলো বেশিই ছিল। হিসাব করে দেখলাম আমরা পাহাড়ের ঝড় দেখেছি, শান্ত আবহাওয়া দেখেছি, ভরা পূর্ণিমা দেখেছি, সূর্যোদয় দেখেছি।
সূর্যোদয় দেখার জন্য আর্মি ক্যাম্পে ফজরের নামাজ পড়ে চলে আসলাম হেলিপ্যাডে। আগেরদিনের হেলিপ্যাড আর আজকের হেলিপ্যাডের আসেপাশের দৃশ্য সম্পূর্ণ আলাদা। আজ কুয়াশার মত কোনো মেঘ নাই। অনেক দূরের সবুজ পাহাড় দেখা যাচ্ছে। দৃষ্টি সীমাকে আটকে দিচ্ছে মাঝে মাঝে একখন্ড মেঘ এসে। সামনের দুই পাহাড়ের গিরিখাতের মধ্য থেকে একটু পর পর দানবাকৃতির মেঘ বের হচ্ছে। আমরা অপেক্ষায় আছি সূর্যের। অপরূপ দৃশ্যাবলীর সমারোহ। পূব আকাশে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ মনে হলো কোনো ষোড়শী নারীর লজ্জা পেয়ে গাল লাল হয়ে যাবার মত মেঘের একটা কিনারা লাল হয়ে উঠেছে। ঠিক লাল নয়, কমলা। দিনের শুরু ঘোষণা করা আনকোড়া সূর্যের আলতো রশ্মি এসে পরেছে মেঘের গায়ে। এতটাই মৃদু আলো যে মেঘ ভেদ করে সে আলো এপাড়ে আসতে পারছে না। সেই সাদা মেঘের উপর কমলা রঙের আভার যে কী রূপ! কোনো ক্যামেরার হয়ত সাধ্যি নাই সে ছবি তোলার। অনেক শব্দ ভান্ডারে ঠাসা কোনো কবি হয়ত পারবেন ঐ মুহূর্তটার বর্ণনা দিতে। শুধু এই দৃশ্যটুকু দেখার জন্য ৩-৪ ঘন্টা পাহাড় বেয়ে আমি বারবার আসতে পারি অপরূপ কেওক্রাডংয়ে!
দার্জিলিংপাড়ায় এক বেলা
কেওক্রাডংয়ে প্রথম রাত থাকার পর ভোরে নাস্তা করে বের হলাম দার্জিলিংপাড়ার উদ্দেশ্যে। ফিরে আসতে হবে দুপুর ২টার মধ্যে। আজ আর বৃষ্টিবাদলা তেমন নেই। হালকা বাতাস আছে। বুঝা যাচ্ছে ঘুর্ণিঝড় বুলবুল শক্তি হারিয়ে নিস্তেজ হয়ে গেছেন। কটেজ থেকে দার্জিলিংপাড়ায় পৌঁছতে আধা ঘন্টার মত লাগল। পাড়ায় ঢুকার সময়ই দেখলাম দুইজন পাহাড়ী কমলা বাগানে যাচ্ছে কমলা ছিঁড়তে। আমরা বলে দিলাম আমাদের জন্য ১০০ পিস কমলা নিয়ে আসতে। টং দোকান থেকে কিনলাম জাম্বুরা, আনারস, আখ, পেঁপে।
ঘুরে দেখলাম পাহাড়ীদের বাড়িঘর। তাদের একজন জুমচাষ নিয়ে নানা তথ্য দিল। কোনো একটা পাহাড়ে চাষের আগে সব জঙ্গল কেটে ফেলা হয়। এরপর জঙ্গলগুলো শুকালে তাতে আগুন দেয়া হয়। আগুনে সব পুড়ে যাবার পর ঐ ছাই সেখানেই পরে থাকে। এরমধ্যে সারি সারি করে একই জমিতে বিভিন্ন শষ্যের বীজ বোনা হয়। প্রথমে হয়ত একটা ধানের চারা লাগালো, এর একটু দূরেই লাগাল ডাল, আরেকটু পরে লাগাল মিষ্টি কুমড়া। এভাবে একই জমিতে নানান ধরনের ফসল ফলান তারা।
দার্জিলিংপাড়া থেকে আমরা ১২ টা আনারস আর ৫০ পিস কমলা কিনলাম পরদিন ঢাকা নিয়ে আসার জন্য। রুমা বাজারে টেস্ট করার জন্য কমলা কিনেছিলাম। সেগুলো ছিল আকারে ছোট আর ঝাঁঝালো টক স্বাদের। দুই কোয়ার বেশি খাওয়া কঠিন। তার তুলনায় দার্জিলিংপাড়ার কমলা দেখলাম বেশ ভাল। আমরা ঢাকায় যেরকম কমলা কিনি সেরকমই আকার আর স্বাদ। দেখলাম পাহাড়ের বাচ্চারা কমলা খেতে খেতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মোটামুটি কমলার সিজন। আমরা সিজনের শেষের দিকে আসায় বড় কমলা প্রতি পিস কিনতে হয়েছিল ২০ টাকা দিয়ে। আনারস ছিল ৪০-৫০ টাকা। এত বোঝা নিয়ে তো আমরা ফিরতে পারব না। তাই ১২ টা আনারস আর ৫০ টা কমলা একজন পাহাড়ী গিয়ে দিয়ে আসলেন বগালেক। এই বাবদ খরচ করতে হয়েছিল ৪০০ টাকা।
দার্জিলিংপাড়া থেকে পাহাড়ে ফেরার আগে ওখানকার টং দোকানে পরদিন সকালের নাস্তার জন্য অর্ডার করে গেলাম। নাস্তায় থাকবে বাঁশের ভিতরে রান্না করা “ব্যাম্বু চিকেন”। আলু ভর্তা, আদা ফুল আর হলুদ পাতার চাটনি, বাঁশ কোড়াল (বাঁশের গোড়ার নরম অংশ) আর ডাল। আর যথারীতি জুম চাষের চালের ভাত। সব মিলিয়ে জন প্রতি ২০০ টাকা করে রেখেছিল নাস্তার প্যাকেজ। উপরের অ্যালবামে খাবারের ছবিগুলো পাওয়া যাবে।
পুরো ট্যুরে একটা বিষয়ে বরাবরের মতই মর্মাহত হলাম। পাহাড়ের রাস্তা থেকে শুরু করে সব জায়গায় প্লাস্টিকের প্যাকেট, বোতল ইত্যাদি ফেলে রাখা। বগালেকে এক পাহাড়ী মুরুব্বিকে দেখে খুব লজ্জা লাগছিল। তিনি একটা একটা করে চকলেটের খোসা, সিগারেটের ফিল্টার, কেক-চিপসের প্যাকেট তুলে ঝুড়িতে রাখছেন। যারা এরকম জায়গায় বেড়াতে যায় তাদের টাকা পয়সা, সামাজিক স্ট্যাটাস বা শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ কম। এরপরেও আমরা গিয়ে আমাদের সকল টুরিস্ট স্পটগুলোকে ময়লার ভাগাড় বানিয়ে দিয়ে আসি। আমরা কি আসলে জাতিগত ভাবেই নোংরা?
বান্দরবান ট্যুরের সবচেয়ে খরচের জায়গা হচ্ছে চান্দের গাড়ি। আমরা শনি-রবি-সোম তিন দিনের জন্য ভাড়া করেছিলাম ১৫,০০০ টাকায়। আমরা ১২ জনের টিম হওয়ায় জন প্রতি খরচ কমে গিয়েছিল। গাড়ি ভাড়া করে ২ জন গেলেও প্রায় একই খরচ হত। বগালেকে রাত্রি যাপন জন প্রতি ১৫০ টাকা, কেওক্রাডংয়ে ৩০০ টাকা। খাবার খরচ প্রতি বেলা ১২০ থেকে ২০০ এর মধ্যে। আমরা কেওক্রাডংয়ে এক রাত বেশি থেকেছি আর খাওয়া-দাওয়ায় ভাল খরচ করেছিলাম। সাথে ঢাকার জন্য কিনেছিলাম আনারস ও কমলা। এতে পুরো ট্যুরে খরচ হয়েছে ৮০০০ টাকার একটু বেশি। আপনি বান্দরবান ঘুরতে যাবার আগে ৮-১০ জনের টিম করে আসলে খরচ অনেকটাই কমে আসবে। নিচে আমাদের গাইড ও গাড়ির ড্রাইভারের ফোন নাম্বার দিচ্ছি। গাইডের সাথে যোগাযোগ করলে সে গাড়ি, কটেজ সব কিছু আগে থেকে বুক করে দিবে। সব মিলিয়ে গাইড আলী ভাইকে বেশ পছন্দ হয়েছে, তার আন্তরিকতার জন্য। ফোন দিয়ে আমার নাম বললে উনি চিনবেন। ট্যুর থেকে ফেরার পরেও উনার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হয়।
রুমা বাজার, বান্দরবানের গাইড মোহাম্মদ আলীর ফোন নাম্বারঃ 01871681175, 01586132582
রুমা বাজার, বান্দরবানের চান্দের গাড়ির ড্রাইভার আবদুল আজীজঃ 01838754927
পরদিন মঙ্গলবার ভোরে উঠে পরিষ্কার আকাশে কেওক্রাডংয়ের সূর্যোদয় দেখা হলো। যার বর্ণনা ও ছবি আগেই দেয়া হয়েছে। আটটার মধ্যে বিদায় জানালাম কেওক্রাডংকে। দার্জিলিংপাড়ায় গিয়ে নাস্তা করতে হবে। এরপর যেতে হবে বগালেক। সেখানে চান্দের গাড়ি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। বগালেক থেকে দুপুরে বের হয়ে রুমা বাজারে গাইড আলী ভাইকে বিদায় জানালাম। বান্দরবান শহরে পৌঁছলাম মাগরিবের একটু আগে দিয়ে। রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলাম। দেখা গেল শত শত ফানুস উড়ছে।
পাহাড়কে একলা রেখে আমরা ছুটে চললাম ইট পাথরের জঞ্জালের গন্তব্যে। আসলেই কি পাহাড়কে রেখে চললাম? নাকি নিজেরাই পাহাড় হয়ে চলছি অবিরত? আমাদের মধ্যেই কি পাহাড় নেই? পাহাড়ের মত কত শত আনন্দ, দুঃখ, বেদনা সঙ্গে করে নিয়ে চলছি। পাহাড়ের কঠিন পাথর ভেদ করে তার কান্না বয় ঝর্ণা হয়ে। সেই কান্নার জল আনন্দের জোগান দেয় অন্য কাউকে। আমাদের মধ্যে বুকে পাথর বেঁধে রাখা মানুষের সংখ্যা কি খুব কম? সকল মানুষই একেকটা পাহাড়ের মত। একেকটা সমুদ্রের মত। প্রতিটা মানুষই একেকটা মহাকাব্যের মত। নগরের অলিতে গলিতে থাকা দলিত পাহাড় মানবেরা সুখী হোক। এই কামনায় শেষ করছি আজকের আলাপচারিতা।
অনেকদিন থেকেই
আমার একটা পাহাড় কেনার শখ।
কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না।
যদি তার দেখা পেতাম, দামের জন্য আটকাতো না।
আমার নিজস্ব একটা নদী আছে,
সেটা দিয়ে দিতাম পাহাড়টার বদলে।
কে না জানে পাহাড়ের চেয়ে নদীর দামই বেশি।
পাহাড় স্থানু, নদী বহমান।
তবু আমি নদীর
বদলে পাহাড়ই কিনতাম।
কারণ আমি ঠকতে চাই।– পাহাড় চূড়ায় ॥ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
This is nice post .bro.Ame jat ci help me