কোনো একদিন মগে গরম দুধ খাচ্ছিলাম। গরম কমানোর জন্য মগটাকে ভূমির সমান্তরালে চক্রাকারে ঘুরাচ্ছিলাম। যেন মগে থাকা দুধ দ্রুত ঠান্ডা হয়। এরপর আবিষ্কার করলাম, আমার দেড় বছর বয়সী বাচ্চাকে কাপে করে ঠান্ডা দুধ দেয়ার পর সেও একই ভাবে দুধের কাপটা ঘুরাচ্ছে।
বাচ্চারা অনুকরণ প্রিয়। তারা বড়দেরকে যা করতে দেখে সেরকম কাজ করার চেষ্টা করে। সবক্ষেত্রে হয়ত না, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তারা বড়দেরকে দেখে ছোট ছোট অনেক কিছুই শেখে। যেমন আমাদের বাসায় কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু হলে বিস্ময়সূচক শব্দ “আ…” ব্যবহার করি। বাচ্চাও সেটা কপি করে নিয়েছে। কোনো খেলনা পড়ে গেলে তখন সেও অবচেতন ভাবেই এই শব্দটা করে।
তাই শিশুকে আদব, ভদ্রতা, নম্রতা সহ যে কোনো ভাল গুণ শিক্ষা দিতে চাইলে বাবা মায়ের ঐ গুণগুলোর চর্চা করার বিকল্প নাই। আমি একজন বাবা যদি সারা বাসায় যতক্ষণ থাকি ততক্ষণ ফোন স্ক্রল করি তাহলে বাচ্চাও ফোন স্ক্রল করার অনুকরণ করবে। আমি যদি বাচ্চাকে সাথে নিয়ে দারোয়ান, রিক্সাওয়ালা বা অধীনস্তদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করি ঐ বাচ্চা এটাই শিখবে।
গতদিন দেখলাম ৩-৪ বছর বয়সী দুটি বাচ্চাকে নিয়ে এক বাবা রাস্তা পার হচ্ছেন। সাথে হয়ত বাচ্চার মাও রয়েছে। ওভার ব্রিজ দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার জন্য পুলিশ রাস্তায় ব্যরিকেড দিয়েছে। লোকটি তার বাচ্চা দুটি এবং সাথের ভদ্রমহিলা সহ ব্যরিকেডের নিচ দিয়ে অতি কষ্টে রাস্তা পার হলেন। বাচ্চা দুটি শিখলো, এভাবেই রাস্তা পার হওয়ার নিয়ম।
একদিন হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে দেখলাম এক বাচ্চা চিপস খাওয়া শেষ করেছে। মা চিপসের প্যাকেটটি নিয়ে ফ্লোরে ছুড়ে ফেললেন। বাচ্চাটা শিখলো, খাওয়ার পর এভাবেই প্যাকেট যেখানে ইচ্ছা সেখানে ফেলে দিতে হয়।
বাসে আমার পাশের সিটে এক ভদ্রলোক বসলেন। কেতা দুরস্ত ভাব, পরিপাটি, মার্জিত সাজ-পোশাক। ব্যাগ থেকে জুস বা চলোকেট মিল্টের একটা প্যাকেট বের করে খেলেন। এরপর জানালা দিয়ে খালি প্যাকেটটি ফেলে দিলেন। থামাতে চেষ্টা করার আগেই কাজটি তিনি করে ফেললেন। মুখ ফসকে বলেই ফেললাম “এটা কী করলেন?” তার উত্তর “কিছু করার নাই”। বললাম খালি প্যাকেটটা সহজেই ব্যাগে রেখে দেয়া যেত। অফিসে গিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে দিতেন।
ছোট বেলা থেকেই হয়ত তার অভ্যাস এটা। বড়দেরকে দেখেছেন হয়ত এভাবেই ইচ্ছা মত যেখানে খুশি সেখানে ফেলা যায়। উচ্চ শিক্ষিত হয়েছেন, বড় অফিসে কাজ করছেন; কিন্তু তার স্বভাবটা পরিবর্তন হয় নি।
খাওয়ার পর টিশ্যুটা বা খালি প্যাকেটটা যে ব্যাগে বা জামার পকেটে রেখে দেয়া যায় সেটা একটা বাচ্চাকে বলে বলে শেখানো হয়ত কঠিন। তার মনে থাকবে না। কিন্তু তাকে সাথে নিয়ে যদি এই এক্সারসাইজটা করা যায়, তাহলে এটা তার মাসল মেমরিতে গেঁথে যাবে।
একটা বাচ্চা যদি দেখে বাসার সবাই খাওয়ার শুরুতে “বিসমিল্লাহ” বলছে। খাওয়া শেষে “আলহামদুলিল্লাহ” বলছে। ঘুমের আগের দুআ পড়ছে, ঘুম থেকে উঠে দুআ পড়ছে। ওয়াশ রুমে যাওয়ার আগে দুআ পড়ছে, বের হয়ে দুআ পড়ছে। আযান হওয়ার সাথে সাথে নামাজ পড়ছে, নিয়মিত কুরআন পড়া হচ্ছে। তাহলে এই বাচ্চাটার বড় হওয়া আর এর বিপরীত পরিবেশের একটা বাচ্চার বড় হওয়া কি এক হবে? দুই জনের শিক্ষা-আদব-কায়দা কি এক হবে?
বাচ্চাদেরকে বলে বলে শেখানোর পাশাপাশি তার সামনে বাবা-মায়েরা যদি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে পারেন তাহলে শিশুর শেখাটা পরিপূর্ণ হবে ইনশাআল্লাহ। এই পোস্টটি আমার নিজের জন্য রিমাইন্ডার হিসাবে লিখা। যেন আমি আমার বাচ্চাকে যেই গুণাবলীতে দেখতে চাই, আমার মধ্যে সেই গুণাবলীর অনুশীলন করতে পারি। বাচ্চার উত্তম স্বভাব, আমল-আখলাক্বের আগে আমার স্বভাব ও আমল-আখলাক্ব ঠিক করতে হবে। আমি যেন তার সামনে অনুকরণীয় উত্তম দৃষ্টান্ত হিসাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারি। কারণ –