পোস্টটি পড়া হয়েছে 4,172 বার
birth story

আমাদের ১ম সন্তান মুহাম্মাদের জন্ম – বার্থ স্টোরি

Post updated on 2nd May, 2024 at 07:31 pm

আমাদের প্রথম সন্তান মুহাম্মাদ বিন হাসান। আল্লাহর অশেষ রহমতে পৃথিবীর বুকে এসেছে ২১ রমাদান ১৪৪৫ হিজরি, ১ এপ্রিল ২০২৪, ১৮ চৈত্র ১৪৩০, সোমবার ফজরের আযানের পরপর আনুমানিক ভোর ৪:৪০ মিনিটে। মানিকগঞ্জের ফিরোজা জেনারেল হাসপাতালের লেবার রুমে নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে মুহাম্মাদের জন্ম হয়। কিছু জটিলতার জন্য প্রায় ২৪ ঘন্টা NICU তে রাখতে হয়েছিল। মুহাম্মাদের পৃথিবীতে আসার পুরো জার্নিটা ব্লগে লিখে রাখছি। যেন ভবিষ্যতে আমি এবং অন্যান্য পাঠকগণ এখান থেকে উপকৃত হতে পারেন।

পোস্টের সূচীপত্র

  1. সন্তানের জন্য পরিকল্পনা ও দুআ
  2. কনসিভ করলো উম্মে মুহাম্মাদ (মুহাম্মাদের মা)
  3. গর্ভাবস্থা, প্রসব ও পরবর্তী বিষয়ে পড়াশোনা শুরু
    1. সহায় প্রেগনেন্সি অ্যাপ
    2. রৌদ্রময়ী প্রিনাটাল কোর্স
    3. অনলাইন দৌলা সার্ভিস
    4. প্রেগনেন্সি ও প্যারেন্টিং বিষয়ক যে বইগুলো আমরা পড়েছি
  4. ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জে স্থানান্তর
    1. OGSB Hospital Mirpur 1 এ আমাদের স্বপ্নভঙ্গ
    2. মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের ফিরোজা হাসপাতালের সিদ্ধান্ত গ্রহন
  5. পানি ভাঙার পর হাসপাতালে ভর্তি
  6. আল্লাহর রহমতে ২৪ ঘন্টা সময় ন্যাচারাল্যি পেইন ম্যানেজমেন্ট
  7. আমার আহলিয়ার প্রথম নরমাল ডেলিভারি বিষয়ে আমার কিছু উপলব্ধি ও শিক্ষা

সন্তানের জন্য পরিকল্পনা ও দুআ

২০২৩ সালে আমি এবং আমার আহলিয়া (স্ত্রী) হজে যাই। আমাদের ইচ্ছা ছিল সন্তানের দায়িত্ব আসার আগেই আমাদের উপর ফরজ হওয়া আল্লাহর বিধান হজ পালন করার। তাই সন্তান নেয়ার আগেই হজের নিয়ত করি। আল্লাহ আশাতীত জায়গা থেকে হজের অর্থের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমরা দুইজন একত্রে হজ করে এসেছি, আলহামদুলিল্লাহ। হজের সফরে আমাদের অন্যতম প্রধান দুআ ছিল:

رَبِّ هَبْ لِى مِنَ ٱلصَّـٰلِحِينَ

অর্থ: হে আমাদের রব্ব! আমাদেরকে নেককার সন্তান দান করুন (সূরা সফফাত, আয়াত ১০০)

رَبَّنَا هَبۡ لَنَا مِنۡ اَزۡوَاجِنَا وَ ذُرِّیّٰتِنَا قُرَّۃَ اَعۡیُنٍ وَّ اجۡعَلۡنَا لِلۡمُتَّقِیۡنَ اِمَامًا

অর্থ: হে আমাদের রব, আপনি আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে। আর আপনি আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন (সূরা ফুরকান, আয়াত ৭৪)

কনসিভ করলো উম্মে মুহাম্মাদ (মুহাম্মাদের মা)

আল্লাহ আমাদের দুআ কবুল করেছেন। হজের সফর থেকে ফেরার মাসখানেক পর সম্ভবত উম্মে মুহাম্মাদ কনসিভ করে। কনসিভ করার পর দেখলাম ধীরে ধীরে আমাদের জীবনের কেন্দ্র বিন্দু পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। বিয়ের পর আমাদের জীবন প্রদক্ষিণ করত স্বামী-স্ত্রীর একে অন্যের জীবনকে ঘিরে। মুহাম্মাদ পেটে আসার পর খেয়াল করছিলাম দুইজনের জীবন ও চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে গর্ভের মুহাম্মাদকে কেন্দ্র করে।

এরকমই নাকি হয়! সকল বাবা-মায়ের জীবনই এক সময় পরিচালিত হয় সন্তানের জীবন ও ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে। এক বড় ভাই বলছিলেন, তারা বাসায় আত্মীয় স্বজনকে দাওয়াত দেয়া কিংবা কোনো আত্মীয়ের বাসায় দাওয়াত নেয়ার আগে শিডিউল দেখে নেন তার ছেলের কলেজের পরীক্ষা আছে কিনা। প্রতিটি বাবা-মায়ের অন্তরেই আল্লাহ এই দরদ ও ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ।

গর্ভাবস্থা, প্রসব ও পরবর্তী বিষয়ে পড়াশোনা শুরু

হজের মত গর্ভাবস্থা ও প্রসব বিষয়েও আমাদের সমাজে পড়াশোনা ও জ্ঞানার্জন নেই বললেই চলে। হজের সফরে গিয়ে দেখেছি মানুষ কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই হজে চলে এসেছেন। এজেন্সিকে টাকা দিয়েই অধিকাংশ মানুষ নিশ্চিন্ত হয়ে আছেন। ধারনাটি যেন এমন: “এজেন্সিই আমার হজ করিয়ে দিবে”। হজের মত এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটা ইবাদত মানুষজন কোনো রকম ইলম অর্জন করা ছাড়াই করতে রওনা হয়। হজ যাদের উপর ফরজ, তাদের উপর হজের মাসআলা ও নিয়মকানুনের ইলম অর্জনও যে ফরজ। এই সহজ বিষয়টি অনেকে বুঝেন না বা জানেন না। তাই দেখা যায় হজ করতে আসা বহু মানুষই জানেন না ইহরাম কী? আরাফা, মুযদালিফা, মীনা – এগুলো কী? তালবিয়া কী সেটাও অনেকের অজানা। অনেকেই এমন আছেন হজে এসেছেন কিন্তু তালবিয়াটাও শুদ্ধ করে পাঠ করতে পারেন না। তাদের দেখে মন খারাপ করা ছাড়া তেমন কিছু করারও থাকে না।

একই রকম বিষয় দেখা যায় গর্ভাবস্থা ও প্রসব বিষয়ে মানুষের জানাশোনার ক্ষেত্রে। অনেক মানুষই চান নরমাল ডেলিভারি হবে। কিন্তু নরমাল ডেলিভারির জন্য কোনো প্রস্তুতি থাকে না। আদৌ প্রস্তুতি নিতে হয় কিনা সেটাও থাকে অনেকের অজানা। ফলে আমাদের দেশে বেড়ে গেছে অপ্রয়োজনীয় অনেক সিজারিয়ান ডেলিভারি। কারণ মানুষ জানেই না কোন সিচুয়েশনে নরমাল ডেলিভারির জন্য অপেক্ষা করা যায়। আর কোন সিচুয়েশন আসলে সিজার করা ছাড়া বিকল্প থাকে না।

আল্লাহর অশেষ রহমতে আমরা হজের আগে প্রায় ১ বছর হজের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। আমার আহলিয়া নরমাল ডেলিভারির জন্য খুব আগ্রহী ছিলেন। আল্লাহ তার এই আগ্রহকে সত্য পরিণত করে দিয়েছেন। প্রেগনেন্সির প্রায় শুরু থেকে আমরা গর্ভাবস্থা, নরমাল ডেলিভারি, ব্রেস্ট ফিডিং ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মতান্ত্রিক পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। আল্লাহ তাঁর রহমতের চাদরে আমাদের ঘিরে রেখেছেন। তাই এই বিষয়গুলো নিয়ে পড়াশোনা করার গুরুত্ব উপলব্ধি করার তাওফিক দিয়েছেন। যারা এই লেখাটি পড়ছেন, দুআ করি তারাও এ বিষয়গুলো নিয়ে পর্যাপ্ত পড়াশোনা করে empowered হউন।

আমরা যে সকল জায়গা থেকে গর্ভাবস্থা ও প্রসব বিষয়ে জেনেছি সেগুলো নিচে তুলে ধরা হলো।

সহায় প্রেগনেন্সি অ্যাপ

ডাক্তার তাসনিম জারার সহায় প্রেগনেন্সি অ্যাপের মাধ্যমে আমাদের প্রাথমিক জ্ঞানার্জন শুরু হয়। ৩ দফায় অ্যাপের সাবস্ক্রিপশন কিনেছিলাম। প্রতি সপ্তাহে একটি করে ভিডিও পাওয়া যেত অ্যাপে। প্রতিদিনের জন্য থাকত স্বাস্থ্য টিপস। প্রেগনেন্সির প্রতিটি সপ্তাহের করণীয় ও নানাবিধ শারীরিক-মানসিক পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে এখানে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। প্রতি সপ্তাহে গর্ভের বাচ্চার বৃদ্ধি কী রকম হবে? কী কী খাবার খাওয়া উচিত? মেডিকেল চেকাপের সময় ডাক্তারকে কোন কোন বিষয় জানানো উচিত? ইত্যাদি বিষয় এখান থেকে সহজে জানা যায়।

আমার আহলিয়ার প্রেগনেন্সির মাঝামাঝি সময়ের কোনো একটা সপ্তাহে ঘুমের মাঝে হঠাৎ পায়ের রগে টান লাগে। তীব্র ব্যথায় ঘুম ভেঙে যায়। একটু ভয় পেয়েই গিয়েছিলাম আমরা। পরে সহায় প্রেগনেন্সির ঐ সপ্তাহের স্বাস্থ্য টিপস বা আর্টিকেলে এক্সাক্ট এই বিষয়টিই পাওয়া গেল। সেখানে বলা হয়েছে যে ঐ সপ্তাহে গর্ভবতী মায়ের পায়ে খিল ধরার সমস্যা হতে পারে। এজন্য একটা ব্যায়ামের পরামর্শ দেয়া হয়। কোনো উঁচু স্থান থেকে কোনো কিছু পাড়ার সময় যেভাবে পায়ের অগ্রভাগের উপর ভর করে উঁচু হয়ে দাঁড়াই। এভাবে কয়েক মিনিট ব্যায়াম করলে পায়ে খিল ধরার সমস্যা কমে যায়। আলহামদুলিল্লাহ, আমার আহলিয়ার ক্ষেত্রেও ব্যায়ামটি করে উপকার হয়েছিল।

তাই আপনি যদি সন্তান নেয়ার পরিকল্পনা করেন। সেক্ষেত্রে সহায় প্রেগনেন্সি অ্যাপের সাবস্ক্রিপশন কেনাটা একটা ভাল ইনভেস্টমেন্ট হতে পারে।

রৌদ্রময়ী প্রিনাটাল কোর্স

প্রেগনেন্সি বিষয়ে আমাদের সবচেয়ে বেশি জানার সুযোগ হয়েছে Mother & Child Care BD নামক প্ল্যাটফর্মের অনলাইন প্রিন্যাটাল কোর্স থেকে। এটি ছিল লাইভ অনলাইন কাপল কোর্স। আগের কোর্সের রেকর্ডেড ভিডিও কেনার সুযোগ ছিল। কিন্তু আমরা বেছে নিয়েছিলাম লাইভ কোর্সকেই। আগের লিংকে গিয়ে তাদের প্রিন্যাটাল কোর্সের আউটলাইনটা দেখলেই বুঝা যাবে কোর্সটি কতটা তথ্যবহুল ও উপকারি ছিল। এক কথায় বললে, আমাদের জন্য লাইফ চেঞ্জিং কোর্স ছিল এটি।

গর্ভবতী মায়ের ডায়েট চার্ট, তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সাপোর্ট, প্রয়োজনীয় ব্যায়াম, প্রসব প্রক্রিয়া, নরমাল ডেলিভারির সময় ন্যাচারাল্যি পেইন ম্যানেজমেন্ট, প্রসবোত্তর করণীয় কাজ, বাচ্চার জন্য বুকের দুধ খাওয়ানোর পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে খুব ডিটেইলে ক্লাস হয়। কিছু কিছু ক্লাস থাকে যেগুলোতে স্বামীরা জয়েন করতে পারেন না। বেশির ভাগ ক্লাসেই স্বামী-স্ত্রী উভয়েই জয়েন করতে পারেন। বিভিন্ন টপিকে লাইভ ক্লাসের পাশাপাশি বোনাস শর্ট ভিডিও দেয়া হয়। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যায়ামের ভিডিও ও আর্টিকেলের লিংক শেয়ার করা হয়।

মাঝে মাঝে ক্লাসের বিষয়বস্তুর উপর কুইজ হয়। ডায়েট চার্ট করে সেগুলো শেয়ার করতে হয়। প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে অ্যাসাইনমেন্ট করে জমা দিতে হয়। কিছু কাপল অ্যাক্টিভিটি থাকে। যেমন স্বামী-স্ত্রী একসাথে কোনো একটা ব্যায়াম করা। সেটা করা হলে আবার ক্লাসে আপডেট জানাতে হয়। কোর্সের শেষে পরীক্ষাও দিতে হয়।

কোর্স চলাকালীন সময়ে গর্ভবতী মায়েরা কোর্সের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যুক্ত হয়ে প্রেগনেন্সি বিষয়ক যে কোনো প্রশ্ন করতে পারেন। কোর্সের ইন্সট্রাক্টর ও দায়িত্বশীলা ডাক্তার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে থাকেন। মাত্র ১৮৫০ টাকা কোর্স ফী দিয়ে কোর্সটি করার পর মনে হয়েছিল নতুন একটা জগত সম্পর্কে যেন জানলাম।

এই কোর্সটি যে শুধু গর্ভবতী মায়েরাই করেন এমন নয়। অনেক ডাক্তার, নার্স ও মিডওয়াইফগণ এই কোর্সটি করে থাকেন। রৌদ্রময়ী টিম থেকে ডাক্তার-নার্সদের জন্য কোর্স ফী-তে বিশেষ ডিসকাউন্ট দেয়া হয়। যেন এই ডাক্তার-নার্সগণ দেশব্যাপী ন্যাচারাল ডেলিভারি সম্পর্কে মায়েদেরকে আরো বেশি জানাতে পারেন। সরাসরি তারা যেন গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদেরকে ন্যাচারাল ডেলিভারিতে সাপোর্ট করতে পারেন। ডাক্তারদের জন্য এই বিশেষ ছাড়ের কন্সেপ্টটা আমার কাছে বেশ পজেটিভ লেগেছে।

অনলাইন দৌলা সার্ভিস

এই কোর্সটি করার সময় আমরা পরিচিত হলাম অনলাইন দৌলা সার্ভিসের সাথে। দৌলা সাধারনত প্রেগনেন্সি ও ডেলিভারি বিষয়ে অভিজ্ঞ একজন ব্যক্তি। যিনি গর্ভবতী মায়ের সাথে অনলাইনে যুক্ত থেকে তাকে মানসিক সাপোর্ট দেন। মায়ের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকেন। যে কোনো পরিস্থিতিতে তিনি পরামর্শ দিয়ে থাকেন কী করতে হবে। তিনি যেহেতু ডাক্তার নন, তাই তিনি প্রেসক্রিপশন বা চিকিৎসা দেন না। তবে যখন তিনি মনে করেন কোনো একটা পরিস্থিতিতে ডাক্তারকে জানানো উচিত, তিনি সেই পরামর্শ দেন।

যেমন ধরুন কোনো মায়ের হঠাৎ করে ব্লিডিং হচ্ছে। এটা যদি তার অভিজ্ঞতা মতে স্বাভাবিক হয়, তাহলে তিনি মাকে অভয় দিবেন। অন্যথায় বলবেন দ্রুত ডাক্তারকে জানাতে। এভাবে একজন দৌলা অনলাইনে গর্ভবতী মায়ের ৩২তম সপ্তাহ থেকে ডেলিভারির পর ১ সপ্তাহ পর্যন্ত সাপোর্ট দিয়ে থাকেন।

মাত্র ২১০০ টাকায় যেই অসাধারন অনলাইন দৌলা সার্ভিস আমরা পেয়েছি তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। ডেলিভারির আগের পেইন ম্যানেজমেন্টের প্রায় ২৪ ঘন্টা সময় বলা যায় আমাদের দৌলা ফারিয়াব হাসান আপু অনলাইনে আমাদের সাথে যুক্ত ছিলেন। সব সময় সাহস ও মানসিক সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছিলেন। আল্লাহ আপুকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।

প্রেগনেন্সি ও প্যারেন্টিং বিষয়ক যে বইগুলো আমরা পড়েছি

কোনো বিষয় সম্পর্কে গভীর ভাবে জানার জন্য বই পড়ার বিকল্প নাই। আমরাও চেষ্টা করেছি প্রেগনেন্সি ও ন্যাচারাল ডেলিভারি বিষয়ে বইপুস্তক পড়ার। আমাদের সমাজে আমরা সিজারিয়ান ডেলিভারি ও নরমাল ডেলিভারি সম্পর্কে জানি। কিন্তু পড়াশোনা করে বুঝতে পারলাম আরেক রকম ডেলিভারি আছে তা হলো ন্যাচারাল ডেলিভারি। নরমাল ডেলিভারি মানেই ন্যাচারাল ডেলিভারি না। নরমাল ডেলিভারিতে নানা রকম মেডিকেল হস্তক্ষেপ করা হয় ডেলিভারি করানোর জন্য। অপর পক্ষে ন্যাচারাল ডেলিভারিতে কোনো রকম অপ্রয়োজনীয় মেডিকেল হস্তক্ষেপ বা মেডিসিন ব্যবহার করা হয় না। আমরা যদিও ন্যাচারাল ডেলিভারি চাচ্ছিলাম, কিন্তু এটা খুব rare. বাংলাদেশে হাতে গোনা হয়ত ২-১ জন ডাক্তার ন্যাচারাল ডেলিভারি সাপোর্ট করেন। যাই হোক, আমরা ন্যাচারাল ডেলিভারি সম্পর্কে সর্বপ্রথম জেনেছিলাম আমানি বার্থ বইটি থেকে। প্রাসঙ্গিক আরো কিছু বই পড়া হয়েছে। ডেলিভারি ও প্যারেন্টিং বিষয়ে সংগ্রহে থাকা কিছু বইয়ের তালিকা তুলে ধরা হলো:

  1. আমানি বার্থ (Must read) – আয়িশা আল হাজ্জার (সিয়ান পাবলিকেশন)
  2. মা হওয়ার গল্প (Must read) – রৌদ্রময়ী প্রিন্যাটাল টিম (সিয়ান পাবলিকেশন)
  3. সন্তান প্রতিপালন – নুরুল ইসলাম খলিফা
  4. সন্তান প্রতিপালনে এ যুগের চ্যালেঞ্জ – ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন
  5. সন্তান প্রতিপালনে নববী আদর্শ – শাইখ আলি বিন নায়েফ
  6. সন্তান স্বপ্নের পরিচর্যা – মির্যা ইয়াওয়ার বেইগ
  7. স্মার্ট প্যারেন্টিং উইথ মুহাম্মাদ (সা.) – মাসুদ শরীফ
  8. প্যারেন্টিং স্কিলস – সানজিদা সিদ্দিকী কথা
  9. শিশুমনে ঈমানের পরিচর্যা – ড. আইশা হামদান
  10. সন্তানের বয়ঃসন্ধিকালের মনস্তত্ত্ব – প্রফেসর ড. আব্দুল কারিম বাক্কার
  11. শিশুদের সমস্যা আমাদের করণীয় – প্রফেসর ড. আব্দুল কারিম বাক্কার
  12. সন্তান গড়ার কার্যকরী কৌশল – প্রফেসর ড. আব্দুল কারিম বাক্কার
  13. সন্তান গড়ার ১১০ টিপস – মুজাহিদ মামূন দীরানিয়্যাহ

এছাড়াও রৌদ্রময়ী টিমের টেলিগ্রাম চ্যানেল সহ বিভিন্ন সোর্স থেকে পজেটিভ বার্থ স্টোরি পড়া হয়েছে। গর্ভবতী মায়ের জন্য পজেটিভ বার্থ স্টোরি পড়া খুবই উপকারী। এর মাধ্যমে তিনি সাহস, উৎসাহ ও প্রেরণা লাভ করেন। তাই গর্ভবতী মা ও বাচ্চার বাবাদের উচিত প্রচুর বার্থ স্টোরি পড়া। এর মাধ্যমে অনেকের অনেক রকম অভিজ্ঞতা জানার সুযোগ হয়। এর মধ্যে কোনোটা হয়ত আপনার ক্ষেত্রে কাজে লেগেও যেতে পারে।

ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জে স্থানান্তর

আমানি বার্থ বই এবং রৌদ্রময়ী প্রিন্যাটাল কোর্স করার পর আমরা ন্যাচারাল ডেলিভারির বিষয়ে খুব বেশি আগ্রহী হয়ে উঠি। আমরা খুঁজতে থাকি আসেপাশে কোথায় ন্যাচারাল ডেলিভারি সাপোর্টিভ ডাক্তার পাওয়া যায়। কিন্তু এরকম ডাক্তার পাওয়া বিরল ভাগ্যেরই ব্যাপার। প্রেগনেন্সির আগে থেকেই আমরা ডাক্তার শামসুন্নাহার রিক্তা ম্যাডামের কাছে চেকাপ করাতাম। তিনি ঢাকার মিরপুর ১ ডেলটা মেডিকেল কলেজের গাইনী ডিপার্টমেন্টের প্রধান। কিন্তু আমরা নিশ্চিত হতে পারছিলাম না ম্যাডামের আন্ডারে ডেলটা মেডিকেলে ন্যাচারাল ডেলিভারি সম্ভব হবে কিনা।

OGSB Hospital Mirpur 1 এ আমাদের স্বপ্নভঙ্গ

কোর্স চলাকালীন সময়ে রৌদ্রময়ী টিমের থেকে জানতে পারলাম মিরপুর ১ এর OGSB Hospital এর একজন ডাক্তার ম্যাডামের কথা। যার নাম উপরের লিস্টে থাকা “মা হওয়ার গল্প” বইয়ের শেষে উল্লেখ রয়েছে। দেখলাম তিনি ন্যাচারাল ডেলিভারি সাপোর্ট করেন এবং রৌদ্রময়ী থেকে উনাকে রিকমেন্ড করলেন। এমন কি রৌদ্রময়ীর প্রিন্যাটাল কোর্সে তিনি ক্লাসও নিয়েছিলেন। আমরা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম এরকম একজন ন্যাচারাল ডেলিভারি সাপোর্টিভ ডাক্তার আমাদের বাসার আসেপাশেই আছেন। সঙ্গত কারণেই উক্ত ডাক্তার ম্যাডামের নাম উল্লেখ করছি না।

আমরা প্রথমেই উনার চেম্বারে না গিয়ে Mother & Child Care BD এর অনলাইন ক্লিনিকের মাধ্যমে অনলাইনে কথা বলি। ম্যাডামের প্রতি আমাদের ভালো লাগা প্রথম অনলাইন মিটিংয়ে অনেক বেড়ে যায়। পরে সামনা সামনি OGSB হাসপাতালে গিয়ে দেখা করি। ম্যাডাম কিছু টেস্ট দিলেন। রিপোর্ট নিয়ে দেখা করলাম ৩-৪ দিন পর। তাকে বললাম যে, ডেলিভারির জন্য এখনো আমরা কোনো হাসপাতাল সিলেক্ট করি নি। আপনার সাথে কথা বলে এরপর আমরা ডিসিশন নিব। তাই কিছু সময় নিয়ে কথা বলতে চাই। আমরা ম্যাডামকে কিছু প্রশ্ন করলাম। যেগুলো থেকে বুঝা যায় একজন ডাক্তার কতটা ন্যাচারাল ডেলিভারি সাপোর্টিভ। এই প্রশ্নগুলো আমরা পেয়েছিলাম আমাদের অনলাইন দৌলা ফারিয়াব হাসান আপুর থেকে। পাশাপাশি একই বিষয়ে আমরা কোর্স থেকেও জেনেছি। প্রশ্নগুলোর কয়েকটি ছিল এরকম:

  1. ডেলিভারির শুরুতেই গর্ভবতী মাকে এপিসিওটোমি দেয়া (সাইড কাটা) হবে কিনা
  2. ডেলিভারির সময় up-right position এ থাকার সুযোগ দেয়া হবে কিনা? নাকি লিথোটোমি পজিশনেই থাকতে হবে?
  3. পিটোসিন বা অন্যান্য মেডিসিন শুরুতেই দিয়ে দেয়া হয় কিনা
  4. EDD এরপর কতদিন পর্যন্ত ন্যাচারাল্যি পেইন উঠার জন্য আপনি অপেক্ষা করবেন
  5. কখন আপনি সিজারিয়ান ডেলিভারির ডিসিশন নিবেন?

এরকম আরো কিছু প্রশ্ন ছিল। আনফরচুনেটলি, তিনি প্রশ্নের উত্তরগুলো খুব বিরক্তির সাথে দিলেন। প্রশ্নগুলো করার আগের টোন আর পরের টোনে তার আকাশ পাতাল তফাৎ। তিনি জানালেন উনাদের হাসপাতালে রুটিন ওয়ার্ক হিসাবে সকল মাকেই এপিসিওটোমি দেয়া হয়। অর্থাৎ প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক শুরুতেই নরমাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে ডেলিভারির রাস্তা কেটে দেয়া হয়। তিনি এই বিষয়ে উনার অভিজ্ঞতা বললেন এবং জানালেন এই কেটে দেয়াটাই ভাল। যা আমাদের কোর্সের জ্ঞানের সম্পূর্ণ বিপরীত। (আলহামদুলিল্লাহ, আমার আহলিয়ার ডেলিভারির সময় এপিসিওটোমি লাগে নাই)

পজিশনের বিষয়ে তিনি বললেন লিথোটোমি পজিশনেই থাকতে হবে (অর্থাৎ চিত হয়ে শুয়ে ডেলিভারির পজিশন)। অন্য কোনো পজিশনে থাকার সুযোগ নাই। এটাও ন্যাচারাল ডেলিভারির সাথে সাংঘর্ষিক। লিথোটোমি পজিশন লিখে সার্চ দিলে উইকিপিডিয়ায় যে বর্ণনা পাওয়া যায় সেখান থেকেই জানা যায় যে এই পজিশনটা প্রসূতি মায়ের জন্য সবচেয়ে কষ্টকর পজিশন।

যাই হোক, ম্যাডামের কথাগুলো থেকে বিরক্তি ঝড়ে ঝড়ে পড়ছিল। পরে আর তার সাথে দেখা করতে আমাদের ইচ্ছা করে নাই। আমার আহলিয়া উনার কাছে ডেলিভারি করানো দূরে থাক, উনার কাছে সাধারন চেকাপের জন্যও যেতে আর রাজি হয় নি। তাই অনেক সুনাম থাকার পরেও OGSB Hospital Mirpur 1-কে আমাদের চয়েজ লিস্ট থেকে বাদ দিলাম।

আরেকটা পয়েন্ট কাজ করেছিল OGSB কে বাদ দেয়ার ক্ষেত্রে। তা হলো তাদের মিরপুর ১ শাখায় NICU নাই। যদি কোনো বাচ্চার এই সাপোর্ট প্রয়োজন হয় তখন তাকে মিরপুর ১৩ নাম্বার শাখায় পাঠানো হয়। আমাদের বাচ্চার ক্ষেত্রে NICU প্রয়োজন হয়েছিল। তাই এখন এসে বুঝেছি, আল্লাহ আমাদের জন্য উত্তম পরিকল্পনাই করে রেখেছিলেন। কারণ আমাদের বাবুর NICU support লেগেছিল। OGSB তে গেলে এক্ষেত্রে আমরা কঠিন সংকটের মাঝে পড়তাম। আল্লাহ রক্ষা করেছেন।

দৌলা ফারিয়াব আপু বললেন ইস্তেখারার নামাজ পড়ে এরপর ডিসিশন নিতে। আমার আহলিয়া বেশ কিছু দিন ইস্তেখারা করলো। এরপর আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে সিদ্ধান্ত নিল ওর বাবার বাড়ি মানিকগঞ্জেই ডেলিভারি করাবে। আত্মীয়-স্বজন ও আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকেও উৎসাহ দিচ্ছিলো যেন বাবার বাড়িতে কম্ফোর্ট জোনে থেকে ডেলিভারি হয়।

মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের ফিরোজা হাসপাতালের সিদ্ধান্ত গ্রহন

আমার শ্বশুরবাড়ির থেকে ১ মিনিটের হাঁটা পথের দূরত্বে ফিরোজা জেনারেল হাসপাতাল। এর মালিক আমার শ্বশুরের এক আত্মীয়। তিনি আশ্বাস দিলেন পর্দা রক্ষা করে নরমাল ডেলিভারির জন্য তার টিম কাজ করবেন। সেই আশ্বাসে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম মানিকগঞ্জ চলে আসার। আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের এই সিদ্ধান্তটি আল্লাহর রহমতে ভাল ছিল।

পানি ভাঙার পর হাসপাতালে ভর্তি

আমার আহলিয়ার ডেলিভারির আনুমানিক তারিখ ছিল ৮ এপ্রিল ২০২৪। সপ্তাহ শেষে আমি ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জ গিয়েছিলাম দেখা করতে। অফিস থাকায় ঢাকা ব্যাক করলাম ৩০ মার্চ ২০২৪ শনিবার। আমার পেটে সমস্যা থাকায় শনিবার রাতেই ৩১ মার্চ ২০২৪ রবিবার ছুটির জন্য মেইল করলাম।

৩১ মার্চ ২০২৪, রাত ৪টা

সাহরির সময় ঘুম থেকে উঠে মেসেজ দেখলাম রাত ৩টার দিকে আহলিয়ার পানি ভেঙে গেছে। গলগল করে একবারে সব পানি বের হয়ে যাওয়ার মত। কিন্তু কোনো ব্যথা নাই। ৪টার দিকেই ওকে হাসপাতালে ভর্তি করে নেয়া হয়। সাথে সাথেই স্যালাইন দেয়া হয়। যেহেতু বাচ্চা যেই পানির মাঝে থাকে সেটির বেশির ভাগ অংশই বের হয়ে গিয়েছে।

৩১ মার্চ ২০২৪, ভোর ৫টা

ভোর ৫টার দিকে খুব হালকা ব্যথা শুরু হয়। আল্ট্রা করে দেখা গেল পানি কমে হয়েছে ৬। যা আগে ছিল ১৫। নরমাল ডেলিভারির জন্য ৫ এর নিচে অ্যালাউ করা হয় না। অর্থাৎ আমরা এখন নরমাল ডেলিভারির জন্য প্রয়োজনীয় পানির সর্বনিম্ন পরিমাণের কাছাকাছি অবস্থান করছি।

পিভি চেক করে ডাক্তার জানালেন এখনো জরায়ুর মুখ শক্ত। ডায়লেশন শুরু হয় নাই। অর্থাৎ জরায়ুর মুখ এখনো খুলে নাই। অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার নাই। কিন্তু বেশি অপেক্ষা করাও রিস্কি। কারণ জরায়ুর পানি কমে যাওয়ায় বাচ্চার অক্সিজেন সাপ্লাই কমে যাবে। হার্টরেট কমে যাবে। যদিও হার্টরেট তখনও ভাল ছিল।

৩১ মার্চ ২০২৪, দুপুর ১২টা

আমি ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমালাম। ৮টার দিকে সম্ভবত মেসেজ আসলো ব্যথা বেড়েছে। আমাকে অফিসে যেতে নিষেধ করলো। আগেই আমার সিক লিভ নেয়া ছিল। ব্যাগ গুছিয়ে আমি মানিকগঞ্জ রওনা দিলাম। যুহরের আগে হাসপাতালে পৌঁছে দেখি ব্যথা খুব হালকা।

বাচ্চার হার্টরেট ভাল ছিল। অন্যান্য সকল কিছুই আল্লাহর রহমতে ভাল ছিল। শুধু পানি কমে যাওয়ায় আমরা দুশ্চিন্তায় ছিলাম। অনলাইন দৌলা ফারিয়াব হাসান আপুকে টাইম টু টাইম আপডেট জানানো হচ্ছিল। আপুর ইন্সট্রাকশন ছিল ডেলিভারির কোনো সিম্পটম দেখা যাওয়ার সাথে সাথে উনাকে কল করার জন্য। সেটা যত রাতই হোক। তিনি সব শুনে জানালেন যদিও পানি কমে গেছে, তবুও এখনো নরমালের জন্য চেষ্টা করা যেতে পারে। ডাক্তারের সাথে কথা বলতে বললেন।

আল্লাহর রহমতে ২৪ ঘন্টা সময় ন্যাচারাল্যি পেইন ম্যানেজমেন্ট

দুপুরের পর থেকে একটু একটু করে ব্যথা বাড়তে থাকে। আমরা দৌলা ফারিয়াব আপুর পরামর্শ আর প্রিনাটাল কোর্সের ক্লাসের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে হাঁটাহাঁটি ও এক্সারসাইজ করাতে লাগলাম। ক্লাস থেকে লেবারের উপর একটু নোট দেয়া হয়েছিল। সেই নোটটা বারবার পড়ছিলাম। হাসপাতালের ডাক্তার ম্যাডামও পরামর্শ দিয়েছিলেন হাঁটাহাঁটি করতে ও স্কোয়াট করতে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামার সময় একপাশ হয়ে উঠতে-নামতে বললেন। এটা প্রিনাটাল কোর্সেও দেখানো হয়েছিল। এতে হেড এঙ্গেজ হতে সহজ হয়।

কোর্সের ক্লাস থেকে অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী আমাদের ইচ্ছা ছিল বাসায় পেইন উঠবে। এরপর একদম শেষ পর্যায়ে পৌঁছে হাসপাতালে যাওয়া। যেন পেইন ম্যানেজ করার দীর্ঘতম অংশ বাসাতেই কাটানো যায়। হাসপাতালের পরিবেশ যেহেতু অপরিচিত। তাই গর্ভবতী মায়ের জন্য সেটি ডিসকম্ফোর্ট তৈরি করতে পারে। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হয় প্রসূতি মায়ের কম্ফোর্টকে। প্রসূতি মা যতটা রিল্যাক্স আর কম্ফোর্ট থাকতে পারবেন তার লেবার তত ভাল প্রোগ্রেস করবে। মায়ের জন্য যদি সুন্দর ও কম্ফোর্ট পরিবেশ নিশ্চিত করা যায় তখন তার অক্সিটোসিন হরমোন নিঃসরণ হবে। এটি লেবার প্রোগ্রেস করতে হেল্প করবে।

কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা আমাদের কারোর নাই। তাই আমরা যতই ইচ্ছা করি না কেন, আল্লাহর ইচ্ছা ছিল ভিন্ন। আমরা বিশ্বাস করি, এর মাঝেই আছে কল্যান। যদিও আমরা বুঝতে পারি না। আল্লাহর ইচ্ছায় আমার আহলিয়ার ব্যথা শুরু হওয়ার আগেই সব পানি বের হয়ে গেল। তাই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে স্যালাইন নিতে আমরা বাধ্য হলাম। এই স্যালাইন শরীরে শক্তি জোগাবে। একই সাথে জরায়ুর ভিতরে থাকা পানির পরিমাণ বাড়তে সাহায্য করবে।

কোর্সের ক্লাস থেকে জেনেছিলাম লেবারের শুরুতে কিছু খেয়ে নেয়া ভাল। কারণ পরে আর খাওয়ার সময় পাওয়া যাবে না। পরে শুধু খেজুর আর পানি খাওয়ার পরামর্শ ছিল। কারণ কুরআন থেকে আমরা জানতে পারি হযরত মারইয়াম আ. যখন হযরত ঈসা আ.-কে জন্ম দেন। তখন তিনি খেজুর আর পানি খেয়েছিলেন। তিনি খেজুর গাছের ডাল ধরে ঝাকি দিয়ে খেজুর পেড়েছিলেন। অর্থাৎ তিনি প্রসবের সময় up right position এ অ্যাক্টিভ মুভমেন্টে ছিলেন।

কিন্তু আমার আহলিয়া পানি ভাঙার পর আর কিছু খাওয়ার সুযোগ পায় নাই। সাহরির সময় হয়েছিল। কিন্তু না খেয়ে হাসপাতালে গিয়েছিল। মনে করেছিল চেকাপ করে চলে আসবে। কিন্তু তখনই ডাক্তার ভর্তি করিয়ে নেয়ায় আর খাওয়ার সুযোগ হয় নাই। স্যালাইন পুশ করলে প্রসূতি মা ইচ্ছা মত হাটাহাটি করতে পারেন না। এ অবস্থায় প্রয়োজনীয় এক্সারসাইজ করা সহজ নয়। তাই স্যালাইন পুশ করাতে আমাদের অনীহা ছিল। কিন্তু কিছু করার ছিল না। মুখে খাওয়াও নিষেধ ছিল। তবু অল্প কিছু খেজুর আর জমজমের পানি খেয়েছিল।

৩১ মার্চ ২০২৪, মাগরিবের ওয়াক্ত

আমরা ইফতার করে মসজিদে নামাজ পড়ে হাসপাতালে আসলাম। আমাদের জানা ছিল ব্যথার ফ্রিকোয়েন্সি আস্তে আস্তে বাড়তে থাকবে। ব্যথার ডিউরেশনও বাড়তে থাকবে। কিন্তু আমার আহলিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী তখন পর্যন্তও ব্যথা সহ্য করার মত, খুব বেশি ব্যথা না। ব্যথার দৈর্ঘ্য ও ফ্রিকোয়েন্সিও খুব বেশি না। তবে বুঝা যাচ্ছিল একটু একটু করে লেবার প্রোগ্রেস করছে।

আমরা জানি প্রথম ডেলিভারির ক্ষেত্রে এই পেইন থাকতে পারে ৩০ ঘন্টা পর্যন্ত। আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করে অপেক্ষা করছিলাম। প্রতিবেশি ও আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে কেউ কেউ ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন সিজার করিয়ে ফেলতে। যেন অহেতুক ঝুঁকি না নেয়া হয়। আমরা দৌলা আর ডাক্তারের সাথে কথা বলছিলাম। মনে হচ্ছিল খুব বেশি রিস্ক হচ্ছে না অপেক্ষা করায়। তাই তাদেরকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলাম আমরা আরেকটু অপেক্ষা করব।

ডাক্তার ছিলেন রাফিজা রমজান রুম্পা ম্যাডাম। তিনি যখন নিশ্চিত হবেন যে এখন সিজার না করলেই নয়, তখনই কেবল সিজার করব। আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের ডাক্তার অত নামীদামী বা সেলিব্রেটি কেউ ছিলেন না। আমি জানি না রাফিজা ম্যাম আমানি বার্থের এই বৈশ্বিক আন্দোলন সম্পর্কে জানেন কিনা। কিন্তু আল্লাহ তাঁর মাঝে নরমাল ডেলিভারিকে সাপোর্ট দেয়ার মত গুণ দিয়েছেন। তার কোনো কথাতেই আমরা আশাহত বা আতঙ্কিত হই নি। আমাদের মনে হচ্ছিল আমরা তাঁর কথায় ভরসা করতে পারি। তিনি প্রতিনিয়তই আমার আলহিয়াকে সাহস জোগাচ্ছিলেন, স্বপ্রশংস উৎসাহ দিচ্ছিলেন। দেশের প্রতিটি মায়ের ডেলিভারিতে যদি এরকম মমতাময়ী ডাক্তার থাকতেন, তাহলে হয়ত অনেক অপ্রয়োজনীয় সিজার এড়ানো যেত।

৩১ মার্চ ২০২৪, ইশার ওয়াক্ত

আস্তে আস্তে ব্যথা বাড়ছে। ইশার ওয়াক্ত হলে মসজিদে যাব ইশা ও তারাবীহ পড়তে। আজকে ২১তম তারাবীহ। সম্ভাব্য শবে কদরের রাত। কিন্তু আহলিয়া আমাকে যেতে দিল না। বললো হাসপাতালেই ইশা পড়ে নিতে। আমি বাসায় গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে, ইশার নামাজ শেষ করে হাসপাতালে ব্যাক করলাম। এ পর্যায়ে পেইন ম্যানেজ করার জন্য তার কোমরের নিচের অংশে ম্যাসাজ করে দিচ্ছিলাম। প্রিন্যাটাল কোর্সের সেখানো এই ম্যাসাজ ওর ব্যথার সাথে কোপ করতে একটু হলেও সাহায্য করেছে। দৌলা আপু ক্লাসের পড়াগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন। কিছু শর্ট ভিডিও, ম্যাসাজ ইত্যাদি টেকনিক শেয়ার করছিলেন। যেন ন্যাচারাল্যি পেইন ম্যানেজ করা সহজ হয়।

বডির কিছু প্রেশার পয়েন্ট রয়েছে। হাতের কব্জি, কাঁধ ও পায়ের পেছনের দিকে। এই পয়েন্টগুলো আস্তে আস্তে ম্যাসাজ করতে থাকলাম। চেষ্টা করছিলাম ওর বডিকে রিল্যাক্স করার জন্য। যেন ব্যথা আসলে শরীর শক্ত করে না ফেলে। কাজটা যদিও খুব একটা সহজ না বা খুব বেশি সফল হই নি এতে। তবু চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম ডীপ ব্রিদিং এক্সারসাইজের মাধ্যমে ব্যথার অনুভূতি কমানোর জন্য।

৩১ মার্চ ২০২৪, রাত ১০:৩০

রাত সাড়ে দশটার দিকে ডাক্তার রাফিজা ম্যাম আল্ট্রা ও পিভি চেক করলেন। জানালেন পানি কমে এখন ৫ এ এসেছে। জরায়ু মুখ ডায়লেশন হয়েছে ৪ সেন্ট মিটারের মত। আমরা জানি ডায়লেশন মোটামুটি ১০ সেন্টিমিটার হলে বাচ্চা বের হয়ে আসার সুযোগ পায়। বাবুর হার্টরেট তখন ১২৪। তিনি বললেন: নরমাল ডেলিভারি অনেকটাই ডিপেন্ড করে মায়ের মানসিক দৃঢ়তার উপর। আপনার ওয়াইফ আলহামদুলিল্লাহ খুবই স্ট্রং। উনি নরমাল ডেলিভারির জন্য পুরো প্রস্তুত। পানিটা শুধু কম আছে। এছাড়া অন্য সকল কিছু ভাল আছে। বাচ্চার হার্টরেটও ভাল আছে। পানি যেহেতু কম, তাই আপনারা চাইলে ম্যাক্সিমাম সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারেন। এরপরও নরমাল না হলে কোনো একটা ডিসিশনে আসতে হবে।

আমার আহলিয়া ও ফ্যামিলির সাথে কথা বললাম। যেহেতু সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার ক্ষেত্রে ম্যাডাম আপাতত উল্লেখযোগ্য কোনো রিস্ক মনে করছেন না। তাই আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ম্যাডাম বললেন রাতের যে কোনো সময়ে যে কোনো প্রয়োজনে যেন উনাকে খবর পাঠাই। উনি এসে সাপোর্ট দিবেন।

১ এপ্রিল ২০২৪, রাত ১২টা

ব্যথার তীব্রতা বাড়ছে। কিন্তু যেভাবে প্রোগ্রেস হওয়ার কথা ক্লাস থেকে জেনেছিলাম সেভাবে ঠিক এগুচ্ছে না। জেনেছিলাম আস্তে আস্তে প্রতিটা কন্ট্রাকশনের মধ্যকার গ্যাপ কমে আসবে। আর কন্ট্রাকশনগুলোর লেংথ বাড়তে থাকবে। আমার আহলিয়ার ক্ষেত্রে এক দেড় মিনিটের বেশি ব্যথা ছিল না। তীব্রতা ছিল বেশ। প্রতিটা ব্যথা আসার পর আমি কোমরের নিচে ম্যাসাজ করে দিতে থাকতাম। দৌলা আপুর পরামর্শে বিভিন্ন সুন্দর মুহূর্তের কথা কল্পনা করতে মনে করিয়ে দিলাম।

এ সময়ের মাঝেই ও বলতে থাকে যে, ব্যথা তো সেভাবে প্রোগ্রেস হচ্ছে না। ধীরে ধীরে ব্যথা ওকে দুর্বল করে ফেলছে। যেহেতু এখনো ব্যথার দৈর্ঘ্য বাড়ছে না। তার মানে লেবার প্রোগ্রেস হচ্ছে না। আরো অনেক সময় লেগে যাবে।

এক পর্যায়ে ও বলতে থাকে ডাক্তারকে ডেকে পিভি চেক করে দেখতে। যদি হেড এঙ্গেজ না হয় তাহলে সিজার করে ফেলতে। ক্লাস থেকে আমরা জেনেছিলাম ব্যথার তীব্রতায় এরকম কথা প্রায় সব মায়েরাই বলে থাকেন। আমার শ্বশুর যখন জিজ্ঞেস করলো ডাক্তার ডাকব কিনা? ততক্ষণে ও নিজেকে সামলে নিয়ে বললো ডাকতে হবে না, আরো পরে।

১ এপ্রিল ২০২৪, রাত ২টা

চেষ্টা করছিলাম ওকে এক্টিভ রাখার। দৌলা আপু বললেন বাম কাত হয়ে শুয়ে রেস্ট নিতে আর ডীপ ব্রিদিং করতে। এতে বাচ্চার হার্টরেট ভাল থাকবে। এরপর উঠে হাঁটাহাঁটি করতে। এরপর আবার বাম কাত হয়ে শুয়ে রেস্ট নিতে। এই সাইকেল চালাতে থাকলাম। আরো আগে থেকেই চলছিল বার্থ বলে বসা, হিপ রোটেশন, স্কোয়াট ও অন্যান্য কিছু এক্সারসাইজ। রাতের এই অংশে এসে ও আর স্কোয়াট করতে পারছিল না। স্কোয়াটের মত করে বসলেই ব্যথা বেড়ে যাচ্ছিল।

দুআ:

حَسْبِيَ اللّٰهُ لَا إِلٰهَ إِلَّا هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَهُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيْمِ

আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট, তিনি ছাড়া ইবাদতের উপযুক্ত আর মাবুদ নেই। আমি তাঁর উপরই ভরসা করি। আর তিনি মহান আরশের মালিক।

সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫০৮১

শক্তিও প্রায় নিঃশেষ। একটা কন্ট্রাকশন এসে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ও ঘুমিয়ে পড়ছিল। ঘুমিয়ে নাকি সে স্বপ্নও দেখেছে। আবার কয়েক মিনিট পর ব্যথা আসলে জেগে যাচ্ছিল গভীর ঘুম থেকে। তখন কোমরের নিচের অংশে ম্যাসাজ চলে। এক পর্যায়ে আর হাঁটাহাঁটি করতে চাচ্ছিল না। এক রকম জোর করেই উঠিয়ে হাঁটাই। বাম হাতে স্যালাইনের ক্যানুলা। বাম পাশে স্যালাইনের ব্যাগ স্ট্যান্ডের সাথে ঝুলিয়ে হাঁটছেন আমার শ্বাশুরি। ডান পাশে আমি হাত ধরে রেখেছি যেন ব্যালান্স করতে সমস্যা না হয়। এক পর্যায়ে ক্লান্তিতে এই হাঁটার সময়েও ও ঘুমিয়েছে। লোভ দেখাতে থাকতাম যে, একটুখানি হাঁটো, তাহলে ঘুমাতে দিব। এভাবে সময় এগিয়ে যেতে থাকলো।

১ এপ্রিল ২০২৪, রাত ৩টা

প্রতিটা মুহূর্ত যেন কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছিল। একই সাথে আল্লাহর রহমতে আমার আহলিয়া ধৈর্য্যের চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করছিলো। প্রিন্যাটাল কোর্সের একটা লেসন ছিলো ডেলিভারির সময় ব্যথার সাথে যুদ্ধ না করে বরং আল্লাহর কাছে নিজেকে সোপর্দ করা। আল্লাহর কাছে পুরোপুরি সারেন্ডার করা। আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পন করার এই বিষয়টিকে ক্লাসে গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয়েছিল। আমানি বার্থ বইতেও এর উল্লেখ ছিল।

ব্যথার এ সময় নিজেকে চালিয়ে নিতে প্রয়োজন হয় সুন্দর কিছু কল্পনা করার। আমি হজের সফরের কিছু স্মৃতিচারণ করতে থাকলাম। আরাফা থেকে মুযদালিফা আমরা পায়ে হেঁটে এসেছিলাম। যা টিমের বেশির ভাগই এসেছিল গাড়িতে। ঐ সময়ের কষ্টের সাথে আনন্দও ছিল। ঐ আনন্দের কথাগুলো মনে করতে থাকলাম। স্মৃতিচারণ করতে করতে হারিয়ে গেলাম যেন মক্কার পথে প্রান্তরে। পড়তে থাকলাম একটানা তালবিয়া “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক!” বলতে থাকলাম এই ব্যথার মাধ্যমেই জরায়ুর মুখ খুলতে শুরু করবে। এরপর আমাদের কোলে আসবে আমাদের প্রথম সন্তান মুহাম্মাদ। আমরা ওকে নিয়ে আবার হজের সফরে বায়তুল্লাহে যাব। আমরা একসাথে হজ-ওমরা করব। এক সাথে তালবিয়া পড়ব! “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক!” আমি হাজির! হে আল্লাহ আমি হাজির!

এ পর্যায়ে এসেও কন্ট্রাকশনের দৈর্ঘ্য বাড়ছিল না। মাঝের গ্যাপ কমে এসে একটানা ব্যথা হওয়ার কথা। সেটা হচ্ছিল না। ওকে যতই বলছিলাম আর অল্প পথ বাকি। ও কিছুতেই মানছিল না। বলছিল আরো অনেক সময় বাকি। কিন্তু ও আর পারছে না। এক পর্যায়ে স্কোয়াট বাদে বিভিন্ন পজিশনে বসে-শুয়ে থাকার চেষ্টা করছিল। কাতর স্বরে আত্মা কাপিয়ে দেয়া কিছু দুআ করছিল মৃদু স্বরে। ঐ সময়টা সে আসলে কনশাস মাইন্ডে ছিল না। ওর নিজের উপর খুব বেশি কন্ট্রোল বা কনশাসনেস ছিল না।

ক্লাস থেকে জেনেছি, লেবারের এই পর্যায়ে এসে মায়েরা শালীনতাবোধ হারাতে পারেন। আজেবাজে বকাবকি করতে পারেন। কিন্তু আমার আহলিয়া কাতর কন্ঠে দুআ করছিলো:

আয় আল্লাহ! আপনি তো আমাকে বানিয়েছেন। আপনি আমার দিকে দেখুন!

আপনি আমাকে একলা ছেড়ে দিবেন না! আপনার রহমতের চাদর দিয়ে আমাকে ঢেকে দিন!

আপনি তো দয়ালু! আপনি তো আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমার দিকে আপনার দয়ার দৃষ্টি দিন!

আমি জানি না সে এই দুআগুলো কোথা থেকে শিখেছে। পেইন ম্যানেজমেন্টে সাহায্য করার ঐ সময়গুলোতে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নি। পরবর্তীতে যত বার মনে পড়েছে ততবার চোখ ফেঁটে পানি চলে এসেছে। এখন পোস্ট লিখার সময়ও চোখ ছলছল করছে। আল্লাহ দুনিয়ার সকল মায়েদেরকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। আমীন।

যত দুআর কথা মনে আসে সেগুলো একটার পর একটা পড়ছিলাম।

رَبَّنَا آتِنَا فِيْ الدُّنْيَا حَسَنَةً وَّفِيْ الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَّقِنَا عَذَابَ النَّارِ

হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দিন। আর আখিরাতেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে দোজখের আযাব থেকে রক্ষা করুন।

সূরা আল বাকারাহ – ২:২০১

لَا یُكَلِّفُ اللّٰهُ نَفْسًا اِلَّا وُسْعَهَا ؕ لَهَا مَا كَسَبَتْ وَ عَلَیْهَا مَا اكْتَسَبَتْ ؕ رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَاۤ اِنْ نَّسِیْنَاۤ اَوْ اَخْطَاْنَا ۚ رَبَّنَا وَ لَا تَحْمِلْ عَلَیْنَاۤ اِصْرًا كَمَا حَمَلْتَهٗ عَلَی الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِنَا ۚ رَبَّنَا وَ لَا تُحَمِّلْنَا مَا لَا طَاقَةَ لَنَا بِهٖ ۚ وَ اعْفُ عَنَّا ۥ وَ اغْفِرْ لَنَا ۥ وَ ارْحَمْنَا ۥ اَنْتَ مَوْلٰىنَا فَانْصُرْنَا عَلَی الْقَوْمِ الْكٰفِرِیْنَ۠ ۝

আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে কোনো কিছু চাপিয়ে দেন না। সে (ভালো) যা কিছু উপার্জন করবে তা তারই (পক্ষে যাবে) আর সে (মন্দ) যা কিছু উপার্জন করবে তা তারই (বিপক্ষে যাবে)।

হে আমাদের প্রভু! আপনি আমাদের পাকড়াও করবেন না, যদি আমরা ভুলে যাই কিংবা ভুল করি। হে আমাদের প্রভু! আপনি আমাদের ওপর এমন ভারি বোঝা চাপিয়ে দেবেন না, যেমন চাপিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। হে আমাদের প্রভু! আমাদের ওপর এমন কিছু চাপিয়ে দেবেন না, যার সাধ্য আমাদের নেই। আপনি আমাদের ক্ষমা করুন, আমাদের মাফ করুন এবং আমাদেরকে দয়া করুন। আপনি আমাদের অভিভাবক, তাই আপনি আমাদের কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাহায্য করুন।

(সূরা বাক্বারা, আয়াত ২৮৬)

أَسْتَغْفِرُ اللّٰهَ الَّذِيْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ القَيُّوْمُ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ

আমি আল্লাহ্‌র নিকট ক্ষমা চাই, যিনি ছাড়া আর কোনো সত্য মাবুদ নেই, তিনি চিরস্থায়ী, সর্বসত্তার ধারক। আর আমি তাঁরই নিকট তওবা করছি।’

[আবূ দাউদ, হাদীস নং ১৫১৭; তিরমিযী, হাদীস নং ৩৫৭৭]

اَللّٰهُمَّ اَنْتَ رَبِّـيْ لَا اِلٰهَ اِلَّا اَنْتَ خَلَقْتَنِـيْ وَاَنَا عَبْدُكَ وَاَنَا عَلـٰى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ اَعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ اَبُوْءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ وَاَبُوْءُ لَكَ بِذَنْبِـيْ فَاغْفِرْ لِـيْ فَاِنَّهٗ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ اِلَّا اَنْتَ

অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি আমার প্রতিপালক। আপনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমি আপনার গোলাম। আমি আমার সাধ্যমতো আপনার সঙ্গে কৃত ওয়াদা পালন করছি। আমি আপনার কাছে আমার কৃতকর্মের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাই। আমার প্রতি আপনার অনুগ্রহের কথা আমি আপনার সামনে স্বীকার করছি। আমার পাপের কথাও আমি আপনার সামনে স্বীকার করছি। তাই আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। আপনি ছাড়া গোনাহ ক্ষমা করার তো কেউ নেই।

সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৩০৬

لَّاۤ اِلٰهَ اِلَّاۤ اَنۡتَ سُبۡحٰنَكَ ‌ۖاِنِّىۡ كُنۡتُ مِنَ الظّٰلِمِيۡنَ

আপনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই’। আপনি পবিত্র মহান। নিশ্চয় আমি ছিলাম যালিম।

(সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৮৭)

রমযান মাস। সাহরি খাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে প্রায়। আমি বাসায় গিয়ে খেয়ে আসতে চাইলাম। আমাকে ও যেতে দিলো না। বললো বাসা থেকে খাবার নিয়ে আসতে। আমাকে আর ওকে রেখে সবাই গেল সাহরি খেতে। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে। ওর নানু সাহরি খেয়ে আমার জন্য খাবার নিয়ে আসলেন। সময় হয়ত রাত সাড়ে ৩টার মত হবে। আমি খেতে বসেছি। ওর ব্যথা আরো বাড়ছে। নানুর ম্যাসাজেও আর কাজ হচ্ছে না। এক পর্যায়ে ও শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ায়। নানুকে বলতে থাকে এখনি ডাক্তারকে ডেকে আনতে। নানু বললেন ও খেয়ে নিক, তুই বস। ও বাঘিনীর মত হুংকার দিয়ে বললো “আমি বসব না! ডাক্তার ডাকো!”। আমি কোনো মতে খেতে খেতে নানুকে নার্স স্টেশনে যেতে বললাম। কয়েক মিনিটের মাঝে নার্স কৃষ্ণা আপু চলে আসলো। আমি অল্প কিছু খেয়ে দাঁত ব্রাশ করার জন্য রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। কারণ নার্স তখন পিভি চেক করবে।

পিভি চেকের আগে নার্স জানতে চাইলো নিচের দিকে খুব প্রেশার ফিল করছে কিনা? বললো সেরকম প্রেশার নাই। কিন্তু প্রচন্ড ব্যথা আছে। পিভি চেক করে নার্স বললো এখনো মুখ পুরোপুরি খুলে নাই। দেরি আছে। তাও তিনি ডাক্তারকে ডাকতে গেলেন। আল্লাহর অশেষ রহমত যে তিনি ডাক্তারকে ঐ মুহূ্র্তে ডাকতে গিয়েছিলেন।

১ এপ্রিল ২০২৪, রাত ৪টা

ডাক্তার রাফিজা ম্যাম তখন সাহরি খাচ্ছিলেন। ১০-১৫ মিনিটের মাঝে সাহরি শেষ করে চলে আসলেন। পিভি চেক করে বললেন ৬ সেন্টিমিটার ডায়লেশন হয়েছে বা জরায়ুর মুখ খুলেছে। কিন্তু বাচ্চার হেড এঙ্গেজ হয়েছে। মানে জরায়ুর মুখের কাছে বাচ্চার মাথা এসে আটকে আছে। এক্ষণি লেবার রুমে নিতে হবে। আমরা সবাই লেবার রুমের দিকে গেলাম।

প্রিন্যাটাল কোর্সের ক্লাসে আমরা জেনেছিলাম চার হাত-পা ছড়িয়ে বেডে শুয়ে থেকে ডেলিভারি করাকে বলে লিথোটোমি পজিশন। এই পজিশনে পুশ করে বাচ্চাকে বের করা মায়ের জন্য কষ্টকর। কিন্তু ডেলিভারি প্রসেসটা অবজার্ভ করা ডাক্তারের জন্য সহজ। আমার আহলিয়া চাচ্ছিল টুলে বসে বা স্কোয়াট পজিশনে থেকে ডেলিভারি করতে। ম্যাডাম খুব আন্তরিক ভাবে বললেন “আপনি ট্রাই করতে পারেন। কিন্তু আমি তো দেখতে পাব না। বুঝবোও না”। অগত্যা লেবার বেডে উঠতে হলো। Up right position এ থাকার শেষ চেষ্টা হিসাবে ও চাইলে বেডের মাথার কাছের দিকটা খাড়া করে দিতে। সেটাও সম্ভব হলো না। আমি বললাম “ম্যাডাম, লিথোটোমিতে ওর ফিয়ার আছে। সম্ভব হলে যদি পিঠের পিছনে ২টা বালিশ দিয়ে একটু আপ রাইট থাকা যায়…” সেটাও হলো না। ও বেডে উঠতে উঠতেই স্যালাইনের ব্যাগে পিটোসিন পুশ করা হলো। যেন ব্যথা আরো বেড়ে লেবার দ্রুত প্রোগ্রেস করে।

১ এপ্রিল ২০২৪, ভোর ৪:৩১

মানিকগঞ্জে সেদিন সাহরির শেষ সময় ছিলো রাত ৪:৩১। ডেলিভারির জন্য লেবার রুমের কাজ শুরু হলো। সম্ভবত ৪:৩৭ মিনিটে ফজরের আযান হয়েছিল। আযানের ২-৩ মিনিট পর খুব অল্প পুশেই জন্ম হলো মুহাম্মাদের! ঘড়ির কাটায় তখন সময় সম্ভবত ভোর ৪:৪০ মিনিট। পাশের মসজিদের আযান শেষ হয়েছে। দূরে কোথাও হয়ত আযান চলছিল। উৎকন্ঠা ভর করছিল মনে। বাচ্চার কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে না। লেবার রুমের দরজার ফাঁকা দিয়ে দেখলাম মুহাম্মাদের পিঠে চাপড় দিয়ে কান্না করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। ওর মাথার পিছনের দিকটা বেশ লম্বা হয়ে গিয়েছে। কিছুটা লম্বা সময় বার্থ ক্যানেলে হেড এঙ্গেজ থাকায় এরকম লম্বা হয়ে গিয়েছে। জরায়ুতে পানি অনেক কমে যাওয়ায় বাচ্চার শরীরে অক্সিজেনের সাপ্লাই কমে গিয়ে শরীর কালো হয়ে গিয়েছিল।

১ এপ্রিল ২০২৪, ভোর ৪:৪৫

নার্স কৃষ্ণা আপু মুহাম্মাদকে কোলে নিয়ে ছুটলেন NICU এর দিকে। এর মাঝে লেবার রুমে শুনতে পেলাম ছুটোছুটির শব্দ। খুব সম্ভবত, ঐ রাতে ডেলিভারির কথা মাথায় রেখে লেবার রুম ও OT প্রস্তুত রাখা হয় নি। তাই কাজের সময় নার্সরা দৌঁড়ে গিয়ে গিয়ে এটা সেটা যন্ত্রপাতি নিয়ে আসছিল। সাকশনের যন্ত্রটা সম্ভবত লেবার রুমে ছিল না। এখানটাতে কিছুটা মিস ম্যানেজমেন্ট দৃষ্টিগোচর হলো।

মুহাম্মাদকে নিয়ে NICU তে যাওয়ার পর আমাদের সকলের মুখ অন্ধকার। লেবার রুম থেকে একজন আয়া বের হওয়ার পর জানতে চাইলাম বাচ্চার মা কেমন আছে? সে বললো মা ভাল আছে। কোনো সমস্যা নাই। ওর 1st degree tear হয়েছিল। OGSB এর মত রুটিন ওয়ার্ক হিসাবে এপিসিওটোমি লাগে নাই। হালকা টিয়ার সেলাই করে দিয়েছে। সেলাই করার আগে অ্যানেস্থেসিয়া দিলেও সেটা কাজ করে সারতে পারে নি। ম্যাডাম বলে নিয়েছিলেন যে এখন ব্যথা লাগবে।

দৌলা ফারিয়াব আপুর পাঠানো একটি দুআ তখন ক্রমাগত পড়ে যাচ্ছিলাম:

اَللّٰهُمَّ لَا سَهْلَ إِلَّا مَا جَعَلْتَهُ سَهْلاً، وَأَنْتَ تَجْعَلُ الْحَزْنَ إِذَا شِئْتَ سَهْلاً

হে আল্লাহ! আপনি যা সহজ করেছেন তা ছাড়া কোনো কিছুই সহজ নয়। আর যখন আপনি ইচ্ছা করেন তখন কঠিনকেও সহজ করে দেন।

(সহীহ ইবনে হিব্বান ২৪২৭)

আমার শ্বশুরকে বললাম “বাবা, আপনি একটু জায়নামাজে বসেন”। আমি হাসপাতালের কেবিনে গেলাম ফজরের নামাজ পড়তে। নামাজ পড়ে লেবার রুমের সামনে এসে দেখি হাসপাতালের মালিক, আমার শ্বশুরের আত্মীয় সিঁড়িতে দাঁড়ানো। সালাম দিলাম। তিনি প্রথম বাক্যটি বললেন “আপনারা তো বেশি বুঝেন!”। আমি থতমত খেয়ে জানতে চাইলাম “আমরা কী বেশি বুঝলাম?” তিনি বললেন “আপনাদেরকে অসংখ্য বার বলা হয়েছে যে, রিস্ক আছে রিস্ক আছে। আপনারা শুনেন নাই। বেশি বুঝে এই অবস্থা করেছেন”। বললাম যে, রাতে ম্যাডাম চেক করে জানিয়েছিলেন সকাল পর্যন্ত সর্বোচ্চ ওয়েট করা যেতে পারে। তিনি বললেন “আপনাদের জোরাজুরিতে ডাক্তার এটা বলতে বাধ্য হয়েছে”।

সুবহানাল্লাহ!

এমন ক্রিটিক্যাল ও ভঙ্গুর একটা অবস্থায় তিনি সম্পূর্ণ ভাবে অপেশাদার, অমানবিক এবং অসত্য কথা বলে তাকদিরের মন্দ বিষয়টিকে আমাদের দোষ হিসাবে চিহ্নিত করে আমাদের কাঁধে চাপাতে চাইলেন। তাকে ভাল মন্দ কিছুই জিজ্ঞেস করি নি। আমরা তো নিজেরাই জানি যে ডেলিভারিটা কিভাবে হচ্ছে। উনাকে বা উনার কোনো ডাক্তারকে বিন্দু মাত্র দোষ দেয়া হয় নি। কিন্তু তবু বাঙ্গালীর চিরায়ত স্বভাবে তিনি সেফ সাইডে থাকতে পুরো বিষয়টির দোষ চাপালেন আমাদের কাঁধে। এমনিতেই আমাদের মানসিক অবস্থা তখন কেমন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নিজেই আমি গিল্টি ফিলিংসে অস্থির! তার উপর এমন অমানবিক ও অসত্য অভিযোগে আমার ভেঙে পড়ার অবস্থা। ভাল-মন্দ কিছু না বলে সরে আসলাম। আল্লাহকে ডাকতে থাকলাম। হাসপাতাল মালিকের এই বিষয়টাকে আমি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবেই দেখতে চাই। ওভারঅল আমি তাদের সার্ভিসে সন্তুষ্ট। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।

কিছু সময় পর জানা গেল মুহাম্মাদের ফুসফুস কাজ করতে শুরু করেছে। অক্সিজেন সাপোর্টে আছে। একটু পর NICU এর বাইরে থেকে দেখে আসলাম।

এরই মধ্যে আমার আহলিয়ার স্টিচিং শেষ হলো। লেবার রুম ক্লিন করার পর আমি ভিতরে গেলাম। গিয়ে দেখি সে সুস্থ্য স্বাভাবিক মানুষের মত আধশোয়া হয়ে আছে। দেখি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাসছে। যেন কিছুই হয় নাই। একদম নির্ভার, নিশ্চিন্ত। ওর ছেলেকে NICU তে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ওকে দেখে মনে হলো না এটা নিয়ে সে চিন্তিত। যেন আল্লাহ ওকে জানিয়েই দিয়েছেন যে, ওর সন্তান ভাল আছে! আমি ওকে জানালাম যে মুহাম্মাদ ঠিক আছে। এর কিছু সময় পর আহলিয়াকে কেবিনে পাঠিয়ে দিলো। সবাই আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করে বিশ্রাম নিতে গেলাম।

যে বিষয়গুলো আমাদের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সম্ভব ছিল না:

  1. কোর্স থেকে শিখেছিলাম বাচ্চা জন্মের পর ১০-১৫ মিনিট দেরি করে কর্ড কাটতে হয়। কিন্তু এটা সম্ভব হয় নি
  2. বাচ্চা জন্মের পরপর মায়ের বুকের সাথে স্কিন টু স্কিন কন্টাক্ট বা ক্যাঙ্গারু কেয়ার করাতে হয়। এতে বাচ্চার সাথে মায়ের বন্ডিং তৈরি হয়। NICU তে নিয়ে যাওয়ায় এটাও সম্ভব হয় নি
  3. জন্মের সাথে সাথে শাল দুধ দেয়াও সম্ভব হয় নি
  4. জন্মের সাথে সাথে ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামতের শব্দগুলো পড়ে শোনানো সম্ভব হয় নি। ২ দিন পর বাচ্চার মা NICU তে ঢুকে এই আমলটা করেছে

১ এপ্রিল ২০২৪, দুপুর

একজন শিশু বিশেষজ্ঞ মুহাম্মাদকে দেখলেন। বললেন ২৪-৪৮ ঘন্টা অবজারভেশনে রাখতে হবে। হার্টরেট ১২০ হলো নরমাল, আর ওর ছিল ১০২। ওষুধ দিয়েছেন কিছু। অনুমতি দিলেন আহলিয়াকে NICU এর ভিতরে গিয়ে মুহাম্মাদকে দেখে আসার।  আমরা বাইরে থেকে ২-১ বার দেখলাম মুহাম্মাদকে অক্সিজেনের মাস্ক পরিয়ে রেখেছে। দুপুরের পর মাস্ক খুলে দেয়া হলো। শুধু ফ্লুইড যাচ্ছিল ওর শরীরে। আস্তে আস্তে সেরে উঠছিল মুহাম্মাদ।

২ এপ্রিল ২০২৪, সকাল ১০টা

আমার আহলিয়া উম্মে মুহাম্মাদ NICU তে গিয়ে মুহাম্মাদের সাথে দেখা করলো। শুধু মুহাম্মাদের হাত স্পর্শ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। এর আগে সম্ভব না হওয়ায় আহলিয়াই আজান ও ইকামতের শব্দগুলো মুহাম্মাদকে শুনিয়েছে।

২ এপ্রিল ২০২৪, দুপুর ২:৪৫

কয়েকটা টেস্টের রেজাল্ট আসলো। ডাক্তার দেখে জানালেন যে মুহাম্মাদ এখন আল্লাহর রহমতে শংকামুক্ত। ছুটি দিয়ে দেয়া হবে। NICU থেকে ওকে কোলে করে নিয়ে আসলাম কেবিনে।

আজকের দিনটাও আমার আহলিয়া হাসপাতালে কাটিয়ে যেতে চাইলো।

৩ এপ্রিল ২০২৪, বেলা ১১:৩০

হাসপাতাল থেকে বাসায় চলে আসলাম। আহলামদুলিল্লাহ, মুহাম্মাদ ও উম্মে মুহাম্মাদ উভয়েই ভালো আছে।

আমার আহলিয়ার প্রথম নরমাল ডেলিভারি বিষয়ে আমার কিছু উপলব্ধি ও শিক্ষা

  1. ক্লাসে বলেছিল প্রতিটি প্রেগনেন্সি ও প্রতিটি ডেলিভারি ইউনিক। একটার সাথে আরেকটার ধরন হুবহু মিলবে না। আমরা ক্লাসের পড়া অনুযায়ী দীর্ঘ ব্যথা ও লাগাতার ব্যথার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ব্যথা এরকম লাগাতার কখনোই ছিল না। তাই অন্যান্য ডেলিভারির সাথে এটা বড় একটা পার্থক্য ছিল। তাই কোনো একটা নির্দিষ্ট লক্ষণের উপর পুরোপুরি নির্ভর করা যাবে না।
  2. সর্বশেষ ডাক্তার আমার আহলিয়ার পিভি চেক করেছিলেন রাত সাড়ে ১০টায়। এরপর আমরা ডাক্তারকে আবার ডাকি রাত ৪টার দিকে। এত লম্বা সময় ডাক্তারকে না ডেকে অপেক্ষা করাটা উচিত হয় নি। রাত ১টায় অবশ্যই ডাক্তারকে ডেকে আপডেট জানা উচিত ছিল। তাহলে আমাদের রিস্ক অনেকটাই মিনিমাইজ হত। বেবির মাথাটা অনেকক্ষণ বার্থ ক্যানেলে আটকে থেকে লম্বা হয়ে গিয়েছিল। এটা হয়ত কিছুটা এড়ানো যেত। আল্লাহু আ’লাম।
  3. পরবর্তী সময়ে আল্লাহ আমাদেরকে আবার সন্তান দান করলে, ডেলিভারির সময় ইনশাআল্লাহ সার্বক্ষণিক একজন মিডওয়াইফ বা অভিজ্ঞ ধাত্রী হাসপাতালে রাখব। যেন আমাদের পড়াশোনার বাইরেও তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে দ্রুত ডাক্তারকে ডাকতে পারি। যেন বুঝতে পারি এখন ট্রানজিশন স্টেজে আছে নাকি পুশিং স্টেজে এসেছে। শুধু পড়াশোনার উপর ভরসা করা একটু ঝুঁকিপূর্ণ। প্র্যাক্টিক্যাল নলেজ আছে এমন কেউ সাথে থাকলে লেবারের ঝুঁকি কমে আসে।
  4. নরমাল ডেলিভারির পর একজন মা যে রকম রিল্যাক্স ও কনফিডেন্ট ফীল করেন তা অন্য কোনো সময় করেন বলে আমার মনে হয় না। নারীর শক্তি ও ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশের অন্যতম সেরা মাধ্যম মনে হয়েছে নরমাল ডেলিভারি। দীর্ঘ মেয়াদে মা ও শিশুর সামগ্রিক কল্যানের কথা মাথায় রেখে সকল মায়েদের উচিত নরমাল ও ন্যাচারাল ডেলিভারির দিকে আগ্রহ দেখানো। যেই মা বা পরিবার অপ্রয়োজনে সিজার করে তাদের বিষয়ে আমার আহলিয়া এই মন্তব্য করেছিল: “নরমাল ডেলিভারির এইটুকু মাত্র কষ্টের ভয়ে মানুষ কিভাবে স্বেচ্ছায় সিজারের মত একটা দীর্ঘমেয়াদী কষ্টের কাছে নিজেকে সপে দেয়?” আলহামদুলিল্লাহ! সে নরমাল ডেলিভারির কষ্ট ভুলে গিয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে আরো সন্তান দান করলে তখনও সে নরমাল ডেলিভারির জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত!
  5. লেবার পেইনের সময় দুর্বলচিত্তের নিকটাত্মীয় ও পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতি প্যানিকের সৃষ্টি করতে পারে। এমন হতে পারে প্রসূতি মা নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছেন, কিন্তু তার মা-বাবা বা দাদী-নানীদের কারণে মনোবল হারিয়ে ফেলতে পারেন। আল্লাহর ইচ্ছায় লেবারের ব্যথার তীব্রতার সাথে কোনো কিছুর তুলনা হয় না। গর্ভবতী মায়ের পিতা-মাতার জন্য তাদের চোখের সামনে এরকম ব্যথা সহ্য করার দৃশ্য অবলোকন করা খুব কঠিন। তাই প্রয়োজনে পেইন ম্যানেজমেন্টের সময় এরকম নিকটাত্মীয় ও পরিবারের সদস্যদেরকে দূরে রাখার চেষ্টা করা যেতে পারে।

আল্লাহর অসীম দয়া ও করুণার সাক্ষী হওয়া যায় প্রতিটি গর্ভধারনে। কিভাবে অনস্তিত্ব থেকে আল্লাহ একটি শিশুকে অস্তিত্বে নিয়ে আসেন তা ভাবলে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে বের হয়ে আসে “সুবহানাল্লাহ”! আল্লাহর ক্ষমতা ও আমাদের দুর্বলতা উপলব্ধি করা যায় একটি শিশু জন্মের সময়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সুস্থ্য ও নেক সন্তান দান করুন। যে সন্তানেরা আমাদের চক্ষু শীতলতার কারণ হবে। যাদের মাধ্যমে আমাদের মৃত্যুর পরেও কবরে সওয়াব পৌঁছে যাবে সাদকায়ে জারিয়া হিসাবে। আল্লাহ আমাদেরকে এমন সন্তান দান করুন, যারা আমাদেরকে জান্নাতে যেতে সাহায্য করবে। আল্লাহুম্মা আমীন।

3 thoughts on “আমাদের ১ম সন্তান মুহাম্মাদের জন্ম – বার্থ স্টোরি

  1. As-salamu alaykum,
    May Allah (Ar-Rahman, As-Shafi) bless your family and keep them in good health. May Allah (Al-Hadi) make your child the coolness of your eyes. May Allah (Ash-Shakur) give you both unlimited rewards for your patience.
    Jazakallahu kairan for sharing your experience.

  2. Jazakillahu Khairan Vai for sharing this
    May Allah bless you in His gift to you, may you give thanks to the giver of this gift, may the child reach the maturity of years, and may you be granted its righteousness ameen
    Alhamdulilah Amar duita baby normal hoise apnar lekha ta pore shudhu kansi Masha Allah apnar wife how strong she is ! May Allah accept her ameen

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *