কেমন হত যদি আপনার ঘুম ভাঙতো বেলালের (রা) আযানের সুরে? এরপর ফজরের সালাত আদায় করলেন নবীজির (সা) পিছনে। এরপর যদি নবীজি (সা) আপনি সহ অন্যান্য মুক্তাদীদের দিকে মুখ ফিরিয়ে আলোচনা করলেন ঈমান, ইসলাম, জান্নাত কিংবা জাহান্নাম সম্পর্কে। রাতে দেখা কোনো সাহাবীর (রা) স্বপ্নের সুন্দর ব্যাখ্যা করলেন নবীজি (সা)। এরপর নবীজি (সা) হেঁটে চলেছেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীদের (রা) গৃহের দিকে। তাদের সাথে সাক্ষাত শেষে আবার ফিরলেন মসজিদে আপনার বসা মজলিশে। আমরা যদি দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নবীজির (সা) সাথে থাকতে পারতাম! তাঁর কথামালা ও কর্মব্যস্ততা অবলোকন করতে পারতাম! কত দারুন একটা ব্যাপার হত তাই না? “নবীজির (সা) দিনলিপি” বইটি পড়লে আপনার এরকম একটা অনুভূতি হবে। মনে হবে আপনি যেন বাস্তবিক অর্থেই নবীজির (সা) কর্মমুখর একটি দিন চাক্ষুশ দেখতে পাচ্ছেন!
আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা নবী মুহাম্মাদ (সা)-কে তাঁর জীবদ্দশায় পাই নি। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে পেয়েছি তাঁর (সা) হাদীস ও সুন্নাহ। সাহাবীগণ (রা) নবীজিকে (সা) ছায়ার মত অনুসরণ করতেন। নবীজির (সা) কথাগুলোকে শব্দে শব্দে মুখস্থ করে রাখতেন। অনেক সাহাবীগণ (সা) লিখে রাখতেন। নবীজি (সা) দিন-রাতের কখন কী করতেন সেগুলোও হাদীসের মাঝে সুন্দর ভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। হাজার হাজার হাদীসের ভান্ডার থেকে আমাদের পক্ষে নবীজির (সা) জীবনের দিনলিপি বা দৈনন্দিন রুটিন সম্পর্কে ধারনা নেয়া কষ্টসাধ্য। এরকম অসংখ্য হাদীসের সারনির্যাস হচ্ছে নবীজির (সা) দিনলিপি বইটি। লেখক শাইখ আব্দুল ওয়াহহাব ইবনু নাসির আত-তুরাইরি এই বইটি লেখার মাধ্যমে একটি অসাধ্য কাজকেই যেন সাধন করেছেন।
বইটি পড়া শুরু করলে দেখা যাবে পড়া থামানোই মুশকিল! দারুণ গতিময় ও প্রাঞ্জল ভাষায় চমৎকার অনুবাদ করা হয়েছে বইটি। একটানে পুরোটা পড়ে ফেলার মত একটি সুখপাঠ্য বই। নবীজির (সা) একটি কর্মব্যস্ত দিনের শুরুটা কিভাবে করতেন? ফজরের সালাতের শেষে সাহাবীদের (রা) সাথে আলাপ করতেন। এরপর তাঁর (সা) স্ত্রীদের সাথে সাক্ষাত করে আবার মসজিদে ফিরে এসে আলোচনা করতেন। এরপর এক পর্যায়ে তিনি (সা) হাঁটতে বের হতেন মদীনার পথে। হয়ত কোনো একদিন যেতেন কোনো অসুস্থ্য সাহাবীকে দেখতে। পথে কোনো শিশুদের সাথে দেখা হলে মুছে দিতেন তাদের মুখমন্ডল। কেউ তাঁকে (সা) দাঁড় করিয়ে কিছু জানতে চাইলে তিনি সময় দিতেন। যতক্ষণ পর্যন্ত ঐ ব্যক্তি কথা শেষ করে বিচ্ছিন্ন না হচ্ছেন ততক্ষণ তিনি (সা) নিজ থেকে বিচ্ছিন্ন হতেন না। যুহরের আগে দিয়ে বাসায় ফিরে এসে দুপুরের খাবার খেয়ে কিছু সময়ের জন্য ঘুমাতেন। এরপর আযান হলে উঠে নামাজে যেতেন।
যুহরের সালাতের পরে আবারো সাহাবীদের সাথে দ্বীন ও ইসলাম নিয়ে আলোচনা করতেন। দীর্ঘ ও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাগুলো তিনি করতেন ফজর ও যুহরের পরে। কারণ উভয় নামাজের আগেই সাহাবীগণ ঘুম থেকে উঠে প্রানবন্ত হয়ে নামাজে আসতেন। তাই সতেজ অবস্থায় তাদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করতেন। আসর, মাগরিব ও ইশার পরে তেমন বিশেষ বা লম্বা আলোচনা করতেন না। কারণ তখন দিন শেষে সবাই ক্লান্ত থাকতেন এবং রাতের খাবার প্রস্তুতের জন্য ব্যস্ততা থাকতো। ইশার নামাজের পর নবীজি (সা) বাড়ি ফিরে আসতেন। এ সময়ে তিনি বাইরে গল্পগুজব বা আলোচনা করতে নিরুৎসাহিত করেছেন। এই সময়টি ফ্যামিলি টাইম। তাই পরিবারের সাথে কোয়ালিটি টাইম দেয়ার জন্য আমাদেরও উচিত দ্রুত বাসায় ফিরে এসে পরিবারকে সময় দেয়া।
ইশার নামাজের পর বাড়ি ফিরে নবীজি (সা) ঘুমাবার প্রস্তুতি নিতেন। মধ্যরাত পর্যন্ত ঘুমিয়ে উঠে তাহাজ্জুদ পড়তেন। কোনো রাতে তিনি গিয়েছেন কবরস্থানে মৃত সাহাবীগণের (রা) জন্য দুআ করতে। রাতের নামাজ শেষ করে তিনি অল্প কিছুক্ষণের জন্য আবার ঘুমাতেন। হযরত বেলাল (রা) এর আযানের শব্দে উঠে বাড়িতেই ২ রাকাত সুন্নত নামাজ আদায় করতেন। এরপর সাহাবীগণ (রা) মসজিদে উপস্থিত হলে বিলাল (রা) নবীজিকে (সা) নামাজের জন্য ডাকতেন। এরপর ফজরের নামাজ এবং আরেকটি কর্মময় দিনের সূচনা।
উপরে খুব খুব সংক্ষেপে নবীজির (সা) একটি দিনের কার্যক্রমকে এই বইয়ের আলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এখানে বলে রাখা ভাল, বইয়ের দিনলিপিটি কোনো একটি নির্দিষ্ট দিনের নয়। কোনো একটি দিনেই নবীজির (সা) সকল ঘটনাগুলোকে বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে এমনটা নয়। বরং অসংখ্য হাদীসের আলোকে সময় হিসাব করে ঘটনাগুলোকে একটার পর একটা সাজানো হয়েছে। তাই কেউ যেন ভুল না বুঝি। বইটিতে চমৎকার কিছু ঘটনার উল্লেখ আছে। অনেকগুলো দুআ আছে যেগুলো নবীজি (সা) পড়তেন। অনেকগুলো শিক্ষা আমাদের জন্য রয়েছে যেগুলো আমরা আমাদের জীবনে প্রয়োগ করতে পারি। তাই উক্ত বইটি সংক্ষিপ্ত পরিসরে নবীজির (সা) একটি ভিন্নধর্মী সিরাতগ্রন্থ বলা যেতে পারে।
সামগ্রিক ভাবে বইয়ের অনুবাদ বেশ ভাল লেগেছে। পড়ার গতি কখনো বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে বলে মনে পড়ে না। বইটি মূলত পড়েছি অফিসে যাওয়া আসার সময় বাসে এবং ডাক্তারের চেম্বারে অপেক্ষা করার সময়ে। অলস সময়গুলো খুব সুন্দর কেটেছে নবীজির (সা) দিনলিপির সাথে। বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো খুবই মানসম্পন্ন। বইয়ের কভার ও ডিজাইন প্রিমিয়াম কোয়ালিটির। ২-১ জায়গায় পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে লেখার ভাব হয়ত সঠিক ভাবে প্রকাশ পায় নি। বানান ভুল নেই বললেই চলে। থাকলেও সেটি উপেক্ষাযোগ্য। মোটের উপর এক কথায় বললে বলা যাবে খুব ভালো মানের একটি বই। নির্দ্বিধায় কিনে পড়তে এবং কাউকে গিফট করতে পারেন।
বইটি সম্পর্কে কিছু তথ্য
নামঃ নবীজির (সা) দিনলিপি
লেখকঃ শাইখ আব্দুল ওয়াহহাব ইবনু নাসির আত-তুরাইরি
অনুবাদকঃ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ও তাহিরা আমাতুল্লাহ
প্রকাশনায়ঃ মাকতাবাতুল আসলাফ
প্রথম প্রকাশঃ সেপ্টেম্বর ২০১৯
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১৫২
মুদ্রিত মূল্যঃ ২৪০ টাকা
বইটি কাটাবন মসজিদ সংশ্লিষ্ট বইয়ের দোকান, নীলক্ষেত সহ বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া যেতে পারে। আমি নিয়ামাহ বুক শপের মাধ্যমে অনলাইন থেকে সংগ্রহ করেছি।
বেশ সুন্দর প্রানবন্ত রিভিউ
ধন্যবাদ আপনার ফিডব্যাকের জন্য। জাযাকাল্লাহু খাইর।
আলহামদুলিল্লাহ আমি বইটা পড়েছি। চমৎকার একটা বই! পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে যেন ঘটনা গুলো এই মাত্র আমার চোখের সামনে ঘটেছে।