Post updated on 24th July, 2023 at 09:31 pm
হিজরি সনের প্রথম মাস মুহাররম। কুরআনে বর্ণিত চারটি হারাম মাস বা সম্মানীত মাস হচ্ছে জিলক্বদ, জিলহজ্জ, মুহাররম ও রজব। এই চার মাসে যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ। সকল পাপাচার অন্যান্য মাসে যেমন নিষিদ্ধ, এমাসে আরো কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। হাদীস শরীফে মুহাররম মাসকে শাহরুল্লাহ বা আল্লাহর মাস বলে অভিহিত করা হয়েছে।
কুরআন ও হাদীস দ্বারা মুহাররম মাসের মর্যাদা ও ফজিলত সুসংহত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে বর্তমানে মুসলিম সমাজে আশুরার গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপরে উল্লেখিত তাৎপর্যের ব্যতিক্রম। বর্তমানে শিয়া সম্প্রদায়ের শিরকী-বিদআতী আক্বিদা ও কর্মকান্ডের কারণে মুহাররম ও আশুরা বলতেই অনেকে কেবল কারবালার মর্মান্তিক ইতিহাসকেই বুঝে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, মুহাররম ও আশুরার দিবসের মর্যাদা, ফজিলত ও আমলসমূহ কারবালার ঘটনার অন্তত ৫০ বছর আগেই সুস্পষ্ট ভাবে কুরআন ও হাদীস দ্বারা নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে।
আজকের এই পোস্টে কুরআন, হাদীসের আলোকে হক্বানী আলেমদের মাধ্যমে প্রাপ্ত বক্তব্যগুলোর সারসংক্ষেপ তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। যার তথ্যসূত্র পোস্টের শেষে পাওয়া যাবে। এই লেখার মাধ্যমে আমরা জানতে পারব কুরআন ও সুন্নাহ এর আলোকে মুহাররম মাসের মর্যাদা, ফজিলত, আমল ও করণীয় সম্পর্কে। এছাড়াও জানব মুহাররম মাসের বিশেষ ঘটনাবলী সম্পর্কে। এমন কিছু ঘটনা সম্পর্কেও আলোকপাত করা হবে যেগুলো সমাজে প্রচলিত রয়েছে কিন্তু তা বিশুদ্ধতার মানদন্ডে উত্তীর্ণ হতে পারে নাই। পাশাপাশি জানব মুহাররম মাস সম্পর্কে কিছু কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারনা সম্পর্কে।
মহররম কত তারিখে? ২০২৩ সালের আশুরা কত তারিখে?
বাংলাদেশে ২০২৩ সালের মুহাররম মাস শুরু হয়েছে ২০ জুলাই ২০২৩। সে হিসাবে ২০২৩ সালের মুহাররমের ১০ তারিখ বা আশুরার তারিখ ২৯ জুলাই ২০২৩ শনিবার। আশুরা উপলক্ষ্যে সরকারি ছুটি থাকবে ২৯ জুলাই ২০২৩ শনিবার।
মুহাররম সম্মানীত মাসঃ প্রাসঙ্গিক কুরআনের আয়াত
কুরআনুল কারীমে চারটি মাসকে সম্মানীত ও হারাম মাস হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। এই চারটি মাসে যুদ্ধবিগ্রহ ও নিজের প্রতি জুলুম বা পাপ কাজ বিশেষ ভাবে নিষিদ্ধ। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
অনুবাদঃ নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন হতেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাসগুলোর সংখ্যা বারটি, তন্মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস, এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং তার মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম কর না এবং তোমরা মুশরিকদের সাথে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ কর, যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করে এবং জেনে রাখ, নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের সঙ্গে আছেন। (সূরা তাওবা, আয়াত ৩৬)
উক্ত আয়াতে চারটি নিষিদ্ধ মাস বলতে মুহাররমকেও বুঝানো হয়েছে। যা বিভিন্ন সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
মুহাররম সম্মানীত মাসঃ প্রাসঙ্গিক হাদীস
নবীজির (সা) বিদায় হজ্জের ভাষণ সম্পর্কে বুখারী শরীফের একটি হাদীসের অংশ বিশেষ নিচে তুলে ধরা হলো। যেখানে চারটি নিষিদ্ধ মাসের পরিচয় দেয়া হয়েছেঃ
“সময় ও কাল আবর্তিত হয় নিজ চক্রে। যেদিন থেকে আল্লাহ আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। এক বছর হয় বার মাসে। এর মধ্যে চার মাস সন্মানিত। তিনমাস ক্রমান্বয়ে আসে-যেমন যিলকদ, যিলহাজ্জ ও মুহাররম এবং রজব মুদার বা জমাদিউল আখির ও শাবান মাসের মাঝে হয়ে থাকে।…” (বুখারী ৪৪০৬)
মুহাররম মাসের রোজার ফজিলত ও আমল
মুহাররম মাসে আমরা কী কী আমল করতে পারি সে ব্যাপারে আলেমগণ নিচের বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেনঃ
- একান্ত অপারগ না হলে শুধুমাত্র আশুরার দিন অর্থাৎ মহরমের ১০ তারিখ একটি মাত্র রোজা রাখা অনুচিত। বরং আমাদের উচিত মুহাররমের ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ অন্তত দুই দিন রোজা রাখা। আশুরার রোজা দুইটি রাখা উত্তম।
- নবীজি (সা) বলেছেন মুহাররম আল্লাহর মাস। তাই এতে বেশি বেশি রোজা রাখা চাই। এমাসের আইয়ামে বীজের রোজা এবং সপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবারের রোজাগুলো রাখার চেষ্টা করি।
- তওবা ইস্তিগফার করা। এ মাসে অতীতের একটি গোত্রের তওবা কবুল করা হয়েছিল। ইনশাআল্লাহ পরবর্তীদের অনেকের তওবা এই মাসে কবুল হবে।
- দরুদ শরীফ পড়া। তওবা-ইস্তিগফার ও দুআ কবুলের জন্য অন্যতম নিয়ামক হচ্ছে দরুদ শরীফ পড়া। তাই যখনই আমরা ইস্তেগফার বা দুআ করব সাথে সাথে দরুদ পাঠ করব।
- এটা যেহেতু সম্মানীত মাস, তাই এ মাসের সম্মানে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার ব্যাপারে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে।
আইয়ামে বীজের রোজার ফজিলত। এ মাসের আইয়ামে বীজের রোজা কবে?
নিচে মহরমের রোজা সম্পর্কে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হলোঃ
মহরমের রোজাঃ হাদীস ১
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
রমযান মাসের রোযার পরে আল্লাহ তা’আলার মাস মুহাররমের রোযাই সবচেয়ে ফাযীলাতপূর্ণ। (তিরমিযি ৭৪০)
মহরমের রোজাঃ হাদীস ২
আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেছেন, এক ব্যক্তি তাকে প্রশ্ন করল, রামাযান মাসের পর কোন মাসের রোযা রাখতে আপনি আমাকে আদেশ করেন? তিনি তাকে বললেন, এই বিষয়ে আমি কাউকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর নিকট প্রশ্ন করতে শুনিনি। তবে হ্যাঁ এক সময় আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর নিকটে বসা ছিলাম। এই সময় এক ব্যক্তি এসে তাঁকে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! রামাযান মাসের পর আর কোন মাসের রোযা পালনে আপনি আমাকে আদেশ করেন? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ রামাযান মাসের পর তুমি যদি আরো রোযা রাখতে ইচ্ছুক হও তবে মুহাররামের রোযা রাখ। যেহেতু এটা আল্লাহ তা’আলার মাস। এই মাসে এমন একটি দিবস আছে যেদিন আল্লাহ তা’আলা এক গোত্রের তাওবা ক্ববুল করেছিলেন এবং তিনি আরোও অনেক গোত্রের তাওবাও এই দিনে কুবুল করবেন। (হাদীসের মানঃ হাসান গরীব, তিরমিযি ৭৪১)
প্রতি সপ্তাহের সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজার ফজিলত
তাই আসুন, আমরা মুহাররম মাস জুড়েই সাধ্য মত বেশি বেশি রোজা রাখি। বিশেষ করে প্রতি সপ্তাহের সোমবার ও বৃহস্পতিবার এবং হিজরি মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখের আইয়ামে বীজের রোজাগুলো রাখি। কারণ মুহাররম আল্লাহর মাস। আর রোজাও শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য। এবং আল্লাহ ঘোষণা করেছেন রোজার প্রতিদান তিনি নিজেই দিবেন।
আশুরা শব্দের অর্থ কী? আশুরার রোজার গুরুত্ব ও ফজিলত
আশুরা শব্দের অর্থ দশম। ইসলামী পরিভাষায় মুহাররমের দশ তারিখকে আশুরা বলা হয়। এ দিনটিতে নবীজি (সা) বিশেষ গুরুত্ব সহকারে রোজা রাখতেন। ইহুদীরাও আশুরার দিন রোজা রাখত। তাদের সাথে পার্থক্য করার জন্য নবী (সা) মুহাররমের ১০ তারিখের সাথে এর আগে বা পরে একদিন বেশি রোজার রাখতে উৎসাহ দিয়েছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নিম্নোক্ত রোজার ফজিলতগুলো নবীজি (সা) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার অন্তত ৫০ বছর আগে। তাই এই রোজার সাথে কারবালার ঘটনাকে যেন আমরা মিলিয়ে না ফেলি। বা মনে না করি যে, কারবালার ঘটনার জন্যই এই রোজাগুলো রাখা হচ্ছে।
ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) (হিজরত করে) মাদীনায় এলেন এবং তিনি ইয়াহূদীদেরকে ‘আশূরার দিন সিয়াম পালন করতে দেখতে পেলেন। এরপর তাদেরকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার পর তারা বলল, এ সে দিন যে দিন আল্লাহ মূসা (‘আঃ) ও বাণী ইসরাঈলকে ফির‘আওনের উপর বিজয়ী করেছেন। তাঁর সম্মানার্থে আমরা সওম পালন করে থাকি। তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমরা তোমাদের চেয়েও মূসা (‘আঃ)-এর অধিক নিকটবর্তী। এরপর তিনি এ দিনে সওম পালন করার নির্দেশ দিলেন। (মুসলিম ২৫৪৬)
আশুরার দিনের রোজার গুরুত্ব
নফল রোজা রাখার ক্ষেত্রে নবী (সা) আশুরার দিনের রোজাকে অন্যান্য সকল দিনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন।
ইব্নু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন,
আমি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- কে ‘আশুরার দিনের সওমের উপরে অন্য কোন দিনের সওমকে প্রাধান্য প্রদান করতে দেখিনি। এবং এ মাস অর্থাৎ রমযান মাস (এর উপর অন্য মাসের গুরুত্ব প্রদান করতেও দেখিনি)। (বুখারী ২০০৬)
আশুরার দিনের রোজার ফজিলত
মহরমের ১০ তারিখ তথা আশুরার দিন রোজা রাখলে পূর্ববর্তী এক বছরের সগিরা গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দিবেন।
আবূ কাতাদা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
আল্লাহ তা’আলার নিকট আমি আশাপোষণ করি যে, তিনি আশূরার রোযার মাধ্যমে পূর্ববর্তী এক বছরের (গুনাহ্) ক্ষমা করে দিবেন। (তিরমিযি ৭৫২)
আশুরার জন্য রোজা রাখা উচিত দুইটি আর সর্বোত্তম হলো মুহাররমের ৯, ১০ ও ১১ তিন দিন রোজা রাখা
ইহুদীরা আশুরার দিন রোজা রাখত। নবী (সা) তাদের সাথে সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে মুহাররমের ১০ তারিখের সাথে এর আগে বা পরে মোট দুইটি রোজা রাখতে উৎসাহ দিয়েছেন। তাই আমাদের উচিত অন্তত দুইটি রোজা রাখা। বুখারীর ব্যাখ্যা গ্রন্থ ফাতহুল বারীতে ইবনে হাজার আসকালানী (রহ) বলেন আশুরার রোজার সর্বোত্তম অবস্থা হচ্ছে মুহাররমের ৯, ১০ ও ১১ তারিখ ৩ টি রোজাই রাখা। কারণ পুরো মুহাররম মাস ব্যাপী রোজার ফজিলতের কথা সহীহ হাদীসে রয়েছে।
‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেনঃ
রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন ‘আশূরার দিন সিয়াম পালন করেন এবং লোকদের সিয়াম পালনের নির্দেশ দেন। তখন সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! ইয়াহুদী এবং নাসারা এই দিনের প্রতি সন্মান প্রদর্শন করে থাকে। এ কথা শুনে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ইনশাআল্লাহ আগামী বছর আমরা নবম তারিখেও সিয়াম পালন করব। বর্ণনাকারী বললেন, এখনো আগামী বছর আসেনি, এমতাবস্হায় রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইন্তেকাল হয়ে যায়। (মুসলিম ২৫৫৬)
অপর একটি হাদীসের বর্ণনায় পাওয়া যায়ঃ
‘তোমরা আশুরার রোযা রাখ এবং ইহুদীদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে; আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোযা রাখ।’
– মুসনাদে আহমদ ১/২৪১
রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা ফরজ ছিল
রমজানের ১ মাস রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা ফরজ ছিল। যখন রমজানের রোজাকে ফরজ করা হলো তখন আশুরার রোজার বিধান আর ফরজ থাকে নি বরং আশুরার রোজার বিধান হয়ে যায় নফল।
‘আয়িশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন,
জাহিলিয়্যাতের যুগে কুরাইশগণ আশুরার রোজা রাখত এবং আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- ও এ সওম পালন করতেন। যখন তিনি মাদীনায় আগমন করেন তখনও এ সওম পালন করেন এবং তা পালনের নির্দেশ দেন। যখন রমযানের সওম ফরয করা হল তখন ‘আশূরার সওম ছেড়ে দেয়া হলো, যার ইচ্ছা সে পালন করবে আর যার ইচ্ছা পালন করবে না। (বুখারী ২০০২)
সাহরি ও ইফতারের সময়, প্রচলিত কিছু ভুল ধারনা
মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে আশুরার রোজার ব্যাপারে আরেকটু বিস্তারিত ভাবে বলা হয়েছে।
‘আবদুর রহমান ইবনু ইয়াযীদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আশ’আস ইবনু ক্বায়স (রাঃ) ‘আবদুল্লাহ (রাঃ)-এর নিকট গেলেন। তখন তিনি দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, হে আবূ মুহাম্মাদ! তুমি খাওয়ার জন্য কাছে এসো। তিনি বললেন, আজ কি ‘আশূরার দিন নয়? তিনি বললেন, তুমি কি জান ‘আশূরা দিন কী? আশ’আস (রাঃ) বললেন, সে আবার কী? তিনি বললেন, রমাযানের সিয়াম ফরয হওয়ার পূর্বে এ দিন রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সিয়াম পালন করতেন। যখন রমাযানের সিয়াম ফরয হ’ল তখন তা ছেড়ে দেয়া হ’ল। (মুসলিম ২৫৩৮)
সহীহ হাদীস থেকে প্রাপ্ত মুহাররম মাসের দুটি ঐতিহাসিক ঘটনা
মুহাদ্দীসিন কেরাম ও হক্বানী আলেমে দ্বীনদের থেকে আমরা জানতে পারি যে, অতীতে মুহাররম মাসে সংঘটিত দুটি অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা সহীহ হাদীস থেকে পাওয়া যায়। বুখারী, মুসলিম সহ অন্যান্য আরো হাদীসের কিতাবে বিশুদ্ধ বর্ণনা সূত্রে নিচের দুটি ঘটনার উল্লেখ রয়েছেঃ
- হযরত মূসা (আঃ) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের ফেরাউন ও তার সৈন্যদের থেকে মুক্তি পাওয়ার ঘটনা। যেখানে আল্লাহ তাআলা পানির মাঝে রাস্তা বানিয়ে দিয়ে তাঁদেরকে নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছেন।
- ঐ একই রাস্তা দিয়ে পার হওয়ার সময় ফেরাউন ও তার সৈন্যদলের ডুবে মারার ঘটনা
উক্ত ঘটনা দুটির সমর্থনে নিচের হাদীসটি উল্লেখ করা যেতে পারেঃ
ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেনঃ
যখন রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মাদীনাহ্তে এলেন, তখন ইয়াহূদীগণ আশুরার দিন সওম পালন করত। তারা জানাল, এ দিন মূসা (‘আ.) ফিরাউন-এর উপর বিজয় লাভ করেছিলেন। তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর সহাবীদের বললেন, মূসা (‘আ.)-এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার ব্যাপারে তাদের চেয়ে তোমরাই অধিক হাকদার। কাজেই তোমরা সওম পালন কর। (বুখারী ৪৬৮০)
এই দুটি ঐতিহাসিক ঘটনা ব্যতীত যেসকল ঘটনার ব্যাপারে শোনা যায় তার কোনোটিই বিশুদ্ধতার মানদন্ডে উত্তীর্ণ নয়। যেগুলোর অনেক বর্ণনাই এসেছে ইহুদীদের থেকে ইসরাঈলী রেওয়ায়েতের মাধ্যমে। অন্যান্য ঘটনা সম্বলিত হাদীসগুলো অত্যন্ত দুর্বল ও অনেকগুলো জাল বলে প্রমাণিত।
মুহাররম মাসের বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে কিছু দুর্বল ও বানোয়াট বর্ণনা
উপরে উল্লেখিত ঘটনা দুটি ব্যতীত বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে বেশ কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। এ বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে যে, আশুরার দিবসটি ইহুদীদের নিকট সম্মান ও মর্যাদার ছিল। ফলে তাদের মুখে মুখে এ দিবস কেন্দ্রীক নানা কল্প-কাহিনী প্রচলিত ছিল। পরবর্তী যুগে ইসরায়েলী রেওয়ায়েত হিসাবে তা মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করেছে। প্রথম যুগের মুসলিমগণ এগুলোকে সত্য ঘটনা হিসাবে বর্ণনা না করে বরং ইসরায়েলী রেওয়ায়েত হিসাবেই বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী যুগে তা মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পরে হাদীস হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু অভিজ্ঞ মুহাদ্দেসীন কেরামের গবেষণা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে উক্ত বর্ণনাগুলোর ব্যাপারে জানা গিয়েছে যে, সেই বর্ণনাগুলো নবীজির (সা) থেকে সত্যায়িত নয়।
এছাড়াও নবীজির (সা) ইন্তেকালের পর ৬১ হিজরিতে কারবালার প্রান্তরে হযরত হুসাইন (রা) এর শাহাদাতের ঘটনা ঘটে। উক্ত ঘটনার পর পক্ষের ও বিপক্ষের কিছু অবিবেচক দুর্বল ঈমানের মানুষগণ আশুরার দিবসকে কেন্দ্র করে অনেক হাদীস জাল করেছেন। অর্থাৎ তারা নিজেরা ইচ্ছা করে নিজেদের মনগড়া কথাকে হাদীস হিসাবে প্রচার করেছেন। পরবর্তীতে হাদীসের নামে প্রচলিত এসব জালিয়াতিকে মুহাদ্দীসগণ চিহ্নিত করেছেন।
মুহাররম মাস সম্পর্কে অতীত ও ভবিষ্যতের যে সকল বানোয়াট ও জাল কথা প্রচলিত রয়েছে তার মধ্যে কিছু নিচে তুলে ধরা হলোঃ
- আশুরার দিন আল্লাহ তায়ালা হযরত আদমের (আ) তওবা কবুল করেন (অত্যন্ত দুর্বল সূত্রে কোনো কোনো সাহাবী ও তাবেয়ী থেকে বর্ণিত)
- আশুরার দিন হযরত নূহের (আ) নৌকা জুদী পাহাড়ে ভিড়ে (অনির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত)
- আশুরার দিন হযরত ঈসা (আ) জন্মলাভ করেন (অনির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত)
- আশুরার দিনে আল্লাহ আসমান ও যমিন সৃষ্টি করেছেন।
- এ দিনে তিনি পাহাড়, পর্বত, নদনদী সৃষ্টি করেছেন।
- এ দিনে তিনি কলম সৃষ্টি করেছেন।
- এ দিনে তিনি লাওহে মাহফূয সৃষ্টি করেছেন।
- এ দিনে তিনি আরশ সৃষ্টি করেছেন।
- এ দিনে তিনি আরশের উপরে সমাসীন হয়েছেন।
- এ দিনে তিনি কুরসী সৃষ্টি করেছেন।
- এ দিনে তিনি জান্নাত সৃষ্টি করেছেন।
- এ দিনে তিনি জিবরাঈলকে (আ) সৃষ্টি করেছেন।
- এ দিনে তিনি ফিরিশতাগণকে সৃষ্টি করেছেন।
- এ দিনে তিনি আদমকে (আ) সৃষ্টি করেছেন।
- এ দিনে তিনি আদমকে (আ) জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন।
- এ দিনে তিনি ইদরীসকে (আ) আসমানে উঠিয়ে নেন।
- এ দিনে তিনি নূহ (আ)-কে নৌকা থেকে বের করেন।
- এ দিনে তিনি দাউদের (আ) তাওবা কবুল করেছেন।
- এ দিনে তিনি সুলাইমান (আ)-কে রাজত্ব প্রদান করেছেন।
- এ দিনে তিনি আইঊব (আ)-এর বিপদ-মসিবত দূর করেন।
- এ দিনে তিনি তাওরাত নাযিল করেন।
- এ দিনে ইবরাহীম (আ) জন্মগ্রহণ করেন… খলীল উপাধি লাভ করেন।
- এ দিনে ইবরাহীম (আ) নমরূদের অগ্নিকুন্ডু থেকে রক্ষা পান।
- এ দিনে ইসমাঈল (আ) কে কুরবানী করা হয়েছিল।
- এ দিনে ইউনূস (আ) মাছের পেট থেকে বাহির হন।
- এ দিনে আল্লাহ ইউসূফকে (আ) জেলখানা থেকে বের করেন।
- এ দিনে ইয়াকুব (আ) দৃষ্টি শক্তি ফিরে পান।
- এ দিনে ইয়াকূব (আ) ইউসূফের (আ) সাথে সম্মিলিত হন।
- এ দিনে মুহাম্মাদ (সা) জন্মগ্রহণ করেছেন।
- এ দিনে কেয়ামত সংঘঠিত হবে।
- মুহাররমের ২ তারিখে নূহ (আ) প্লাবন হতে মুক্তি পেয়েছেন
- মুহাররমের ৩ তারিখে ইদরীসকে (আ) আসমানে উঠানো হয়েছে
- মুহাররমের ৪ তারিখে ইবরাহীমকে (আ) অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছে
উপরে উল্লেখিত এই ঘটনাগুলোর কয়েকটির বর্ণনাসূত্র খুবই দুর্বল আর বেশির ভাগই হচ্ছে মিথ্যা ও বানোয়াট। তাই আমরা এসকল কথা বর্ণনা করব না। কাউকে এসকল কথা বলতে দেখলে সম্ভব হলে বিনয়ের সাথে ভুল ধরিয়ে দিব।
মুহাররম মাসের ফজিলত সম্পর্কে কিছু দুর্বল, জাল ও বানোয়াট কথা
- “যে ব্যক্তি আশূরার দিনে তার পরিবারের জন্য প্রশস্তভাবে খরচ করবে, আল্লাহ সারা বছরই সে ব্যক্তিকে প্রশস্ত রিযক প্রদান করবেন”। হাদীসটির বর্ণনাসূত্র অত্যন্ত আপত্তিকর ও খুবই দুর্বল। অনেক ইমাম একে জাল হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন।
- মুহাররম মাসে বা আশূরার দিনে দান-সাদকার বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে এ বিষয়ে কিছুই বর্ণিত হয় নি। তবে অত্যন্ত দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য সূত্রে একজন সাহাবী (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, আশুরার দিনে সিয়াম পালন করলে যেহেতু এক বছরের সাওয়াব পাওয়া যায়, সেহেতু এ দিনে দান করলেও এক বছরের দানের সাওয়াব পাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া এ দিনে দানের বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বাতিল ও ভিত্তিহীন কথা।
- “যে ব্যক্তি আশূরার দিনে চোখে ‘ইসমিদ’ সুরমা ব্যবহার করবে কখনোই তার চোখ উঠবে না।” – অধিকাংশ মুহাদ্দীসের মতে এটি জাল ও বানোয়াট কথা। অনেক মুহাদ্দীস বলেনঃ হুসাইন (রা) এর হত্যাকারীরাই এদিন সুরমা ব্যবহারের বিদআত চালু করেছে।
- মুহাররম মাসের কোনো দিবসে বা রাত্রে এবং আশুরার দিবসে বা রাত্রে কোনো বিশেষ সালাত আদায়ের কোনো প্রকার নির্দেশনা বা উৎসাহ কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ক সকল কথাই বানোয়াট। আমাদের দেশে প্রচলিত কোনো কোনো পুস্তকে মহরম মাসের ১ম তারিখে দুই রাক‘আত সালাত আদায় করে বিশেষ দোয়া পাঠের বিশেষ ফযীলতের বিবরণ দেয়া হয়েছে। এগুলো সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা।
- “যে ব্যক্তি আশুরার দিবসে যোহর ও আসরের মধ্যবর্তী সময়ে। অথবা আশুরার রাত্রিতে এত রাকআত সালাত অমুক অমুক সূরা এতবার পাঠ করে আদায় করবে, সে এত পুরস্কার লাভ করবে।” সরলপ্রাণ মুসলিমদের মন জয় করার জন্য জালিয়াতগণ এ সকল কথা বানিয়েছে, যা অনেক সময় সরলপ্রাণ আলিম ও বুযুর্গকেও ধোঁকা দিয়েছে।
- “যে ব্যক্তি মহররমের মাসে রোযা রাখিবে, আল্লাহ তা‘আলা তাহাকে প্রত্যেক রোযার পরিবর্তে ৩০ দিন রোযা রাখার সমান ছওয়াব দিবেন। আরও হাদীছে আছে- যে ব্যক্তি আশুরার দিন একটি রোযা রাখিবে সে দশ হাজার ফেরেশতার, দশ হাজার শহীদের ও দশ হাজার হাজীর ছওয়াব পাইবে। আরও হাদীছে আছে- যে ব্যক্তি আশুরার তারিখে স্নেহ-পরবশ হইয়া কোন এতীমের মাথায় হাত ঘুরাইবে, আল্লাহতাআলা ঐ এতীমের মাথার প্রত্যেক চুলের পরিবর্তে তাহাকে বেহেশতের এক একটি ‘দরজা’ প্রদান করিবেন। আর যে ব্যক্তি উক্ত তারিখের সন্ধ্যায় রোযাদারকে খানা খাওয়াইবে বা ইফতার করাইবে, সে ব্যক্তি সমস্ত উম্মতে মোহাম্মদীকে খানা খাওয়াইবার ও ইফতার করাইবার ন্যায় ছওয়াব পাইবে।” – এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা
- “যে ব্যক্তি আশুরার তারিখে রোযা রাখিবে, সে ৬০ বৎসর রোযা নামায করার সমতুল্য ছওয়াব পাইবে। যে ব্যক্তি ঐ তারিখে বিমার পোরছী করিবে, সে সমস্ত আওলাদে আদমের বিমার-পোরছী করার সমতুল্য ছওয়াব পাইবে।… তাহার পরিবারের ফারাগতি অবস্থা হইবে। ৪০ বৎসরের গুনাহর কাফ্ফারা হইয়া যাইবে”। – এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা
- “যে ব্যক্তি মহররম মাসের প্রথম ১০ দিন রোজা রাখিবে, সে ব্যক্তি যেন ১০ হাজার বৎসর যাবত দিনের বেলা রোজা রাখিল এবং রাত্রিবেলা ইবাদতে জাগরিত থাকিল। … মহররম মাসে ইবাদতকারী ব্যক্তি যেন ক্বদরের রাত্রির ইবাদতের ফযীলত লাভ করিল।… তোমরা আল্লাহ তা‘আলার পছন্দনীয় মাস মহররমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করিও। যেই ব্যক্তি মহররম মাসের সম্মান করিবে, আল্লাহ তাআলা তাহাকে জান্নাতের মধ্যে সম্মানিত করিবেন এবং জাহান্নামের আযাব হইতে বাঁচাইয়া রাখিবেন… মহররমের ১০ তারিখে রোজা রাখা আদম (আ) ও অন্যান্য নবীদের উপর ফরজ ছিল। এই দিবসে ২০০০ নবী জন্মগ্রহণ করিয়াছেন এবং ২০০০ নবীর দোয়া কবুল করা হইয়াছে”। – এগুলো সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা।
মুহাররমের ১০ তারিখ আশুরার দিবস, কারবালার ইতিহাস ও শিয়া সম্প্রদায়
হযরত মুহাম্মদ (সা) এর ইন্তেকালের আগেই ইসলামের সকল বিধিবিধান ও শরীয়ত পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। ইসলামী শরীয়তে কোনো দিবসের মর্যাদা, তাৎপর্য ও ফজিলত নবীজির (সা) ইন্তেকালের আগেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে। কিয়ামত পর্যন্ত এই শরীয়ত পরিপূর্ণ রূপেই সংরক্ষিত থাকবে। আল্লাহ তাআলা নিজে এই শরীয়ত, শরীয়তের দলীল ও দলীলের উৎসসমূহ হেফাযত করার ঘোষণা দিয়েছেন। তাই রাসূলের (সা) ইন্তেকালের পরে এখন আর এই শরীয়তের কোনো হুকুম রহিত হওয়ার সুযোগ নেই।
ইসলামী শরীয়ত যেভাবে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে, আজ পর্যন্ত সেভাবেই সংরক্ষিত আছে। আর সে অনুযায়ীই সবার আমল করা আবশ্যক। তাতে কোনো ধরনের সংযোজন-বিয়োজনের সুযোগ নেই। অতএব রাসূলের (সা) ইনতিকালের পরে সংঘটিত কোনো মুসিবত বা আনন্দের ঘটনাকে কেন্দ্র করে, কোনো দিন বা কোনো মাসের নতুন কোনো ফযীলত বা নতুন কোনো বিধান আবিষ্কার করা যাবে না। এমন করা হলে তা হবে পরিষ্কার বিদআত ও গোমরাহী, যার ঠিকানা জাহান্নাম।
আমরা সকলেই জানি নবীজি (সা) এর মৃত্যুর ৫০ বছর পরে ৬১ হিজরির ১০ মুহাররম কারবালার ঘটনা সংঘটিত হয়। হযরত হুসাইন (রা) ও তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকে ইয়াজিদের বাহিনী নির্মম ভাবে শহীদ করে দেয়। এই ঘটনা প্রতিটি মুসলিমের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করে। এই নির্মম ইতিহাস উম্মাহর প্রতিটি চোখকেই অশ্রুসিক্ত করে। এই বেদনা ভুলে যাবার নয়। এই কষ্ট মুছে যাবার নয়।
আমরা সেই দিনটির কথা স্মরণ করে মনে ব্যথা পাই। আমাদের হৃদয় চুর্ণ বিচুর্ণ হয়। কিন্তু আমরা সেই শোক ও সেই কষ্টকে প্রকাশ করার জন্য এমন কোনো কাজ করি না, যা আল্লাহ অপছন্দ করেন। শোকের কষ্টকে প্রকাশ করার জন্য আমরা এমন কোনো কাজ করি না, যার কারণে আল্লাহ আমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হন!
মৃত ব্যক্তিদের জন্য শোক প্রকাশার্থে মুখে আঘাত করা, বুক চাপড়ানো, জামা ছিড়ে ফেলা, চিৎকার করে বিলাপ করা, মাতম করা এই কাজগুলো ইসলামে নিষিদ্ধ।
‘আবদুল্লাহ্ ইব্নু মাস‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যারা (মৃত ব্যক্তির জন্য শোক প্রকাশে) গন্ডে চপেটাঘাত করে, জামার বক্ষ ছিন্ন করে বং জাহিলী যুগের মত চিৎকার দেয়, তারা আমাদের দলভুক্ত নয়। (বুখারী ১২৯৪)
অন্য একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أَنَا بَرِيءٌ مِمّنْ حَلَقَ وَسَلَقَ وَخَرَقَ.
অর্থাৎ, আমি ঐ ব্যক্তি থেকে মুক্ত, যে শোকে মাথা মুণ্ডায়, বুক চাপড়ায়, কাপড় ছিঁড়ে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬৭, সহীহ বুখারী, হাদীস ১২৯৬
সংক্ষিপ্তাকারে শরীয়তের শিক্ষা এই-
مَهْمَا كَانَ مِنَ العَيْنِ وَالْقَلْبِ، فَمِنَ اللهِ، وَمِنَ الرّحْمَةِ، وَمَا كَانَ مِنَ اليَدِ وَاللِّسَانِ، فَمِنَ الشّيْطَانِ.
চোখ আর দিল থেকে যা কিছু আসে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং তা রহমতের অংশ। কিন্তু যা কিছু হাত ও জিহ্বা থেকে আসে, তা আসে শয়তানের পক্ষ থেকে। -মুসনাদে আহমাদ ১/২৩৮, হাদীস ২১২৭
অর্থাৎ কেবল চোখ বেয়ে অশ্র ঝরা কিংবা পেরেশান হওয়ায় কোনো সমস্যা নেই। এটা মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। এটা ঐ রহমতের প্রকাশ, যা আল্লাহ বান্দার হৃদয়ে দান করেছেন। কিন্তু পেরেশানীর কারণে যদি মানুষ তার হাত কিংবা মুখ ব্যবহার শুরু করে তাহলে এটা হয় শয়তানের আনুগত্য থেকে। এর দ্বারা আল্লাহ তাআলা নারায হন।
আশুরা আসলেই কারবালার স্মরণে শীয়া সম্প্রদায়ের শোক প্রকাশের অনুষ্ঠানে উপরের হাদীসে উল্লেখিত প্রায় সবগুলো কাজই তারা করে থাকে। যেই কাজগুলো করার কারণে নবীজি (সা) ব্যক্তিকে নবীজির (সা) দলভুক্ত নয় এই মর্মে ধমকি দিয়েছেন। সেই কাজগুলো শীয়া ধর্মের অনুসারীরা বছরের পর বছর ধরে করে আসছে।
কোনো বিপদ-আপদ বা শোককে জিইয়ে রেখে দিনের পর দিন স্মরণ করা ইসলামের রীতি নয়। মৃত ব্যক্তির জন্য শোক প্রকাশের ক্ষেত্রে ইসলাম সর্বোচ্চ তিন দিন শোক প্রকাশের অনুমোদন করে। শুধু স্ত্রীর জন্য স্বামীর মৃত্যুতে ইদ্দত পর্যন্ত (গর্ভবতী হলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত অন্যথায় ৪ মাস ১০ দিন) শোক প্রকাশের বিধান রেখেছে। পক্ষান্তরে শিয়া সম্প্রদায় ইসলামের সকল মূলনীতির বিরুদ্ধে গিয়ে হযরত হুসাইনের (রা) শাহাদাত ও তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের শাহাদাতের দিনকে মাতমের দিন বানিয়ে ফেলেছে। মুসিবতের দিনকে মাতমের দিন বানিয়ে ফেলা একটি জাহেলী পদ্ধতি। কোনো একটা দুঃখজনক ঘটনার স্মরণে যদি মাতম করা ও বছরের পর বছর ঐ দিনে শোক প্রকাশ করা জায়েজ হত, তাহলে নবীজির (সা) ইন্তিকালের দিনটিকেই তো সর্বাগ্রে মাতমের দিন বানানো হত! হযরত আবু বকর, ওমর, উসমান, আলী (রা) প্রমুখ সাহাবীগণের ইন্তিকালের দিনগুলোকে মাতমের দিন বা শোকের দিন বানানো হত। দেখা যেত সারা বছরই মুসলিমদের জন্য কোনো না কোনো মহান ব্যক্তির জন্য মাতম বা শোকের দিন।
ইসলাম এরকম শোক প্রকাশ ও মাতম আহাজারিকে সমর্থন করে না। শিয়াগণ তাদের আশুরার অনুষ্ঠানগুলোতে যা করে তার প্রায় সবই হাদীসের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ ও গুনাহের কাজ।
না বুঝে অনেক সরল মনা মুসলিমও তাদের সাথে যোগ দেয়। তারা মনে করে নবীজির (সা) পরিবারের প্রতি ভালবাসা ও মহব্বত প্রকাশের পদ্ধতি বুঝি এটাই! আল্লাহ আমাদেরকে শিয়াদের ফিতনা থেকে হেফাজত করুন।
আশুরার দিন শীয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিল, শোকের মাতম
বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশে আশুরার দিন শীয়া ধর্মের অনুসারীগণ তাজিয়া মিছিল বের করে। পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার করা হয় যে “যথাযোগ্য মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পালিত হলো পবিত্র আশুরা দিবস। তাজিয়া মিছিলে কারবালার দৃশ্যায়ন ও শোকের মাতমে মূহ্যমান গোটা শহর!”। সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী একটা অনুষ্ঠানকে মুসলিমদের অনুষ্ঠান বলে প্রচার করে অনেক মিডিয়া। মিডিয়া কর্মীরা হয়ত জানেও না যে ইসলাম ও মুসলিমদের সাথে উক্ত আচার-অনুষ্ঠানের দূরতম সম্পর্কও নাই।
আশুরার দিন শীয়া সম্প্রদায় বিভিন্ন শিরকী, বিদআতী ও ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ড পারিচালনা করে। শীয়াদের এই অনৈসলামিক কাজের মহড়া শুরু হয় মুহাররম মাসের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর থেকে। শহর জুড়ে দেখা যায় তারা ড্রাম বা ঢোল জাতীয় বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে, খালি পায়ে, কালো কাপড় পড়ে, শরীরে শিকল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়। সম্ভবত এই দশদিন তারা গোসল করা ও ঐ বেশভূসা পরিবর্তন করা থেকেও দূরে থাকে।
শীয়া ধর্মের বিভিন্ন শিরক ও বিদআতী আক্বিদাগুলো এক দিনে সৃষ্টি হয় নি। তারা দিনের পর দিন তাদের উর্বর মস্তিষ্ক (!) থেকে বিভিন্ন বিশ্বাস, আক্বিদা এবং কর্মপদ্ধতির আবিষ্কার করেছে। এ সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিত বলা হয়েছে ড. রাগেব সারজানীর লিখা শীয়া মতবাদঃ বিবাদ বনাম ভ্রষ্টতা নামক বইতে। উক্ত বইয়ের উপর আমার ব্লগে একটি রিভিউ লিখেছি। আগ্রহী পাঠক চাইলে শীয়া মতবাদঃ বিবাদ বনাম ভ্রষ্টতা বইয়ের রিভিউটি এখান থেকে পড়ে নিতে পারেন। তাহলে তাদের বিভ্রান্ত হওয়ার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও বিভ্রান্ত আক্বিদাগুলো সম্পর্কে কিছুটা ধারনা নিতে পারবেন।
আশুরার দিন কারবালার স্মরণে শীয়ারা যে শোকের মাতমে হায় হোসন! হায় হোসেন! করে এটা তাদের জন্মলগ্নে ছিল না। হযরত হুসাইন (রা) এর শাহাদাতের ৩০০ বছর পর ৩৫২ হিজরিতে মুঈযযুদ দাওলা দাইলামী নামক শিয়া ১০ মুহাররম তারিখে বাগদাদে হযরত হুসাইনের (রা) জন্য মাতম করার নির্দেশ দেয়। এরপর ৩৬৩ হিজরিতে আল-মুঈযযু লিদীনিল্লাহি ফাতিমী নামক বেদ্বীন কট্টর শিয়া মিশরেও উক্ত নির্দেশ জারি করে। সেখান থেকে শিয়াদের শোক মিছিল ও মাতম করার ইবাদত চালু হয়।
তাযিয়া মিছিলের আক্বিদা ও বিশ্বাসটি সম্পূর্ণ ভাবে অনৈসলামিক এবং একটি শিরকী আক্বিদা। তাজিয়া বলতে বুঝানো হয় নবীজি (সা) এর প্রাণপ্রিয় নাতী হযরত হাসান (রা) ও হযরত হুসাইন (রা) এর প্রতিকী কবর।
আশুরার দিন শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা শোকর্যালী বা মিছিলে দুটি কবরের প্রতিকৃতি নিয়ে আসে। সেই প্রতিকী কবর দুটিকে তারা জমকালো করে সাজায়। তাদের অনেকের মধ্যে এই বিশ্বাসও রয়েছে যে ঐ কবরে হযরত হাসান (রা) ও হযরত হুসাইন (রা) অবতরণ করেন। সেই বিশ্বাসের জায়গা থেকে ঐ কবরের পাদদেশে তারা মান্নতের বিভিন্ন নজরানা পেশ করে। ঐ কবরগুলোর দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ানো থেকে বিরত থাকে। কবরের সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ায় ও প্রার্থনা করে। কবর দুটিকে বিশেষ সম্মান করে।
কবরের সাথে তারা বহন করে ঘোড়ার মূর্তি। ইসলামে যেখানে মূর্তি বানানো নিষেধ, সেখানে শীয়ারা নিজেদেরকে মুসলিম হওয়ার মিথ্যা দাবী করা সত্ত্বেও তাদের মিছিলে ঘোড়ার মূর্তি বানিয়ে নিয়ে আসে। সেই ঘোড়াও তাদের কাছে বিশেষ সম্মানের। সেই ঘোড়ার গায়ে ও পায়ে তারা বিভিন্ন নিয়তে সূতা বাধে, মান্নত করে। অনেককে দেখা যায় শিশুদের কল্যাণ কামনার্থে ঘোড়ার মূর্তির গায়ে হাত বুলিয়ে সেই হাত শিশুদের মাথায় ও শরীরে মুছে দেয়। এর দ্বারা তারা নানাবিধ কল্যাণ কামনা করে।
তাজিয়া মিছিলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও আকর্ষনীয় (!) অংশ সম্ভবত শরীরে আঘাত করে রক্তাক্ত করা এবং ছুড়ি-তলোয়ার ও আগুণ নিয়ে বিভিন্ন সার্কাসের কৌশল প্রদর্শন করা। শরীরে আঘাত করে, বুকের কাপড় ছিড়ে, বুক চাপড়ে শোক বা আহাজারী করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষেধ। এভাবে শোক প্রকাশকারী এবং যারা এর দর্শক তাদের প্রতি আল্লাহর নবী (সা) অভিশাপ দিয়েছেন। তাই আমরা এসকল বিভ্রান্ত কর্মকান্ডের মজলিসে বা অনুষ্ঠানের কাছেও যাব না।
তাজিয়া মিছিল বিষয়টি আসলে নানা রকম শিরক, বিদআত, কুসংস্কার ও ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ডের সমন্বয়ে একটি প্যাকেজ প্রোগ্রাম। এর থেকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে। স্রেফ দেখার জন্য বা মজা নেয়ার জন্যও এরকম কার্যক্রমের কাছে যাওয়াও ঠিক হবে না।
মহরমের জারি গান ও বিষাদ সিন্ধু
এক সময় আমাদের দেশের গ্রামে-গঞ্জে মহরমের জারি গান, মহরমের কবিতা, মহরমের পুঁথি ও বিষাদ সিন্ধু পাঠের আসর বসত। এখনো সেরকম জারি গানের আসর বসে কিনা এ সম্পর্কে কোনো তথ্য আমার কাছে নাই। দেশের মুরুব্বি স্থানীয় বয়োজ্যোষ্ঠ্য অনেক লোকেরই হয়ত কারবালার ইতিহাসের ভিত্তি হচ্ছে ঐসকল জারি গান, পুঁথি ও বিষাদ সিন্ধু।
পূঁথি সাহিত্য বর্তমানে প্রচলন না থাকলেও স্থানীয় ভাবে জারি গান বা কাছাকাছি ধরনের কিছু গানের চর্চা হয়ে থাকতে পারে। গ্রামেগঞ্জে পীরের দরবার, মাজার, ওরশ ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে এখনো গানবাজনার মাধ্যমে এরকম ইতিহাস চর্চা হয়ে থাকে। গ্রামের অনেক মানুষই মহরমের জারি বা বিচার গান থেকে কারবালার বিকৃত ইতিহাস জেনে আসছে। তাই আমাদের উচিত হবে এসকল জারি গান, পুঁথি ইত্যাদিকে ইতিহাস বা সত্য ঘটনা হিসাবে গ্রহন না করা। বরং সত্যিকারের ইতিহাস জানার জন্য হক্বানী আলেমদের দারস্থ হওয়া। শীয়া সম্প্রদায়ের লিখা ও প্রচার করা বই-বক্তব্য থেকে নিজেদের হেফাজত করা জরুরি। পোস্টের শেষে তথ্যসূত্র অংশে কারবালার ইতিহাস সংক্রান্ত দুই একটি লিংক দেয়ার চেষ্টা করেছি।
মীর মোশাররফ হোসেনের লিখা বিষাদ সিন্ধু উপন্যাস আমাদের দেশে বিখ্যাত। কারবালার ইতিহাসের কথা আসলেই অনেকে বিষাদ সিন্ধুর কথা নিয়ে আসেন। বিষাদ সিন্ধু আসলে একটা উপন্যাস। সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করে, মনের মাধুরী মিশিয়ে আজগুবি কাহিনী হচ্ছে বিষাদ সিন্ধু। তাই বিষাদ সিন্ধুকে স্রেফ উপন্যাস বা কল্পকাহিনী হিসাবে উল্লেখ করব। এটাকে পবিত্র গ্রন্থ হিসাবে বিশ্বাস করে এর ভিতরে থাকা কথাগুলোকে ইতিহাস হিসাবে বিশ্বাস করা যাবে না। বিষাদ সিন্ধু পড়ে থাকলে একথা আপনিও স্বীকার করবেন যে বইটির আগাগোড়া প্রায় সবটুকুই আজগুবি ও বানোয়াট কথা। তাই আমাদের বিশ্বাসের জায়গাটি পরিশুদ্ধ রাখা কাম্য।
মুহাররম মাসের কিছু বর্জনীয় কুসংস্কার ও কুপ্রথা
মুহাররম মাসকে আল্লাহ সম্মানীত করেছেন। এ মাসে যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ করেছেন। নিজের উপর জুলুম করা বা পাপ কাজগুলোকে নিষেধ করেছেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে শীয়া ধর্মের অনুসারীদের অপচেষ্টার কারণে মুহাররম মাসে মুসলিম সমাজ নানাবিধ কুসংস্কার ও কুপ্রথা দ্বারা আক্রান্ত। অনেক মুসলিম জানেই না যে কারবালার ঘটনার আরো অন্তত ৫০ বছর বা আরো আগেই আশুরার দিবসের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফজিলত হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে।
আমাদের সমাজে মুহাররম ও আশুরার দিবস সংক্রান্ত যত ভ্রান্ত বিশ্বাস, কুসংস্কার ও কুপ্রথা প্রচলিত রয়েছে তার থেকে কয়েকটি নিচে তুলে ধরা হলো।
- মুহাররম মাসকে “অপয়া” বা “কুলক্ষুণে” মনে করা। মুহাররম মাসকে সমাজের অনেক মানুষই “অশুভ” মনে করে। এজন্য মুহাররম মাসে বিয়েশাদী বা কোনো ভাল আচার-অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকে। এই ধারণাটি নিঃসন্দেহে শীয়া সম্প্রদায়ের বিভ্রান্তিমূলক বিশ্বাস ও কার্যক্রম থেকে জন্ম নিয়েছে। কুরআনে মুহাররম মাসকে সম্মানীত মাস বলা হয়েছে। আর শীয়াদের থেকে প্রভাবিত হয়ে আমরা অনেকে এই সম্মানীত মাসকে “অশুভ” বা “অপয়া” মাস বলে নেগলেট করি।
- মুহাররম মাস জুড়ে বা মাসের কিছু অংশ শোক প্রকাশের উদ্দেশ্যে কালো বা সবুজ কাপড় পরিধান করা।
- শোকের মাস বা অশুভ মাস মনে করে মাছ, গোশত খাওয়া যাবে না। এটাও একটি কুসংস্কার।
- এ মাসকে শোকের মাস মনে করে মিষ্টি জাতীয় কিছু খাওয়া যাবে না। এটাও একটি কুসংস্কার।
- সারা বছর ভাল খাওয়ার যাবে – এমন ধারণা পোষণ করে আশুরার দিন উত্তম খাবার খাওয়া। এটাও ভিত্তিহীন একটি রেওয়াজ।
- আশুরা উপলক্ষ্যে সমবেত হয়ে ইবাদত বন্দেগী করা। এটাও অনুচিত। কারণ সম্মিলিত ভাবে এই দিনে ইবাদতের কোনো নজির হাদীসে নাই।
- আশুরাকে কেন্দ্র করে বিরানী, খিচুড়ি ইত্যাদির সমন্বয়ে কাঙ্গালী ভোজের আয়োজন করা।
মুহাররম ও আশুরাঃ শেষ কথা
পুরো পোস্টের সারসংক্ষেপ হচ্ছে, মুহাররম মাসে বেশি বেশি রোজা রাখব এবং তওবা করব। আশুরা উপলক্ষ্যে অন্তত দুই দিন রোজা রাখব। এটিই প্রকৃত মুসলিম ও সুন্নাহ এর অনুসারীগণের মুহাররম-আশুরা উদযাপন। তাই মুহাররম ও আশুরা উপলক্ষ্যে এই দুটি কাজই আমাদের করণীয়।
আমরা কারবালার প্রান্তরে শাহাদাতের সুধা পানকারী সকল শহীদদের জন্য জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম লাভের জন্য দুআ করব। তাদের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করব এবং কুরআন-হাদীস অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করব।
এর পাশাপাশি মুহাররম ও আশুরা বিষয়ক সকল ধরনের কুসংস্কার, কুপ্রথা থেকে নিজেদের বিশ্বাসকে পরিশুদ্ধ করব। এ দিবস কেন্দ্রীক শিয়া সম্প্রদায়ের তাযিয়া মিছিল ও তাদের নানাবিধ পাপাচারে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকব। এমন কি তাদের এসকল কার্যাবলীর দর্শকও আমরা হব না।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সিরাতাল মুস্তাকীমের উপর অবিচল রাখুন। আমীন।
পুনশ্চঃ এটি আমার কোনো মৌলিক লেখা নয়। বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য আলেমদের প্রবন্ধ, ভিডিও এবং বই থেকে তথ্যগুলো নিয়ে একত্রিত করেছি মাত্র। এখানে যা কিছু ভাল তা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। আর যা কিছু মন্দ তা আমার জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে এবং শয়তানের পক্ষ থেকে এসেছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা ও দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সাংঘর্ষিক কোনো বিষয় কারো দৃষ্টিগোচর হলে অনুগ্রহ করে কমেন্টে বা মেসেজে জানাবেন। ইনশাআল্লাহ আমি ক্রসচেক করে ভুল সংশোধন করে নিব।
তথ্যসূত্র
- মুহাররম ও আশুরা – কিছু কথা ও কিছু প্রশ্নের উত্তর – মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
- আশুরার দিনে যে কাজগুলো নিষিদ্ধ – মাওলানা তাহমীদুল মাওলা
- ফজিলতপূর্ণ ও মহিমান্বিত মাস মুহাররম – দৈনিক ইনকিলাব
- মুহাররম ও আশুরা : গুরুত্ব ও ফযীলত – মাসিক আলকাউসার
- ইসলামে আশুরার আমল – মাওলানা তাহমীদুল মাওলা
- আশুরা ও মুহাররমঃ কিছু কথা – মাসিক আলকাউসার
- মুহাররম মাসে কি বিয়ে করা যাবে না? – শায়খ আহমাদুল্লাহ
- দশে মুহররমে শিয়াদের মর্সিয়া মাতম মুসলিম উম্মাহর আকিদা বিশ্বাসে কী ক্ষতি করছে? – লুৎফর রহমান ফরায়েজী
- মুহাররমের প্রথম দশ দিন রোযা রাখার ফযীলত সম্পর্কে একটি ভিত্তিহীন বর্ণনা
- আহলে বাইতের দৃষ্টিতে মাতম [শিয়াদের বর্ণনার আলোকে] – মাসিক আলকাউসার
- মুহাররম মাসে করণীয় ও বর্জনীয় – মুফতি মনসূরুল হক
- ইসলামে আশুরার এত গুরুত্ব কেন? – মাওলানা তাহমীদুল মাওলা
- স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রীর শোক পালনের সময়কাল – মাসিক আলকাউসার
- একটি ভুল ধারণা : মুহাররম মাসে বিবাহ করা কি অশুভ
- হিজরী নববর্ষ কিভাবে এলো? মহররম মাসে করনীয় ও বর্জনীয় – আব্দুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ
- আশুরার ইতিহাস বনাম কারবালার ট্রাজেডি; করণীয় ও বর্জনীয়- শায়খ আহমাদুল্লাহ
- ১০ই মহররমের মাতম-মর্সিয়া বন্দেগী না নাফরমানী? – মুফতি লুৎফর রহমান ফরায়েজী
- কারবালার জন্যই কি আশুরার সম্মান? – আবদুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ
- মুহাররম ও আশুরা সংক্রান্ত ১২টি জাল ও যঈফ হাদীস তথা ভেজাল আমল ও ভ্রান্ত ধারণা – শাইখ আহমাদুল্লাহ
- শিয়াদের কুফরী আকিদা – মুফতি লুৎফর রহমান ফরায়েজী
- শিয়া সম্প্রদায় কাফের কেন? – লুৎফর রহমান ফরায়েজী
- কারবালার সঠিক ইতিহাস – ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রাহিমাহুল্লাহ)
- হাদীসের নামে জালিয়াতি – ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রাহিমাহুল্লাহ)
- মুহাররম ও আশুরা: করণীয় ও বর্জনীয় (মাওলানা মাসীহুল্লাহ হাসান)
جَزَاكَ ٱللَّٰهُ خَيْرًا
ওয়া ইয়্যাক
আলহামদুলিল্লাহ।
আলোচনাটি পড়ে খুব ভালো লাগলো।
সবচাইতে বড় বিষয় হলো আলোচনার প্রত্যেকটি অধ্যায় আমাদের আহলে হক দের লিখিত।
জাযাকাল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম
একটা ব্যাপারে কনফিউজড, লিখনীর প্রথমে বলা হচ্ছে, “এই চার মাসে যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ”.
আবার কুরআনের আয়াতের অর্থ থেকে দেখা যাইতেছে, ” এবং তোমরা মুশরিকদের সাথে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ কর, যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করে”.
একটু বুঝিয়ে বলুন।
অনুগ্রহ করে এ আয়াতটির তাফসীর পড়ুন এবং সম্পূরক প্রশ্নগুলো কোনো আলেমের থেকে জেনে নিন।
উক্ত আয়াত সম্পর্কে দুটি মত পাওয়া যায়। একটি হচ্ছে এই চার মাসে যুদ্ধ না করার বিধানটি রহিত হয়ে গিয়েছে। অপর মতটি হলো এই বিধানটি রহিত হয়ে যায় নি, বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে এই চার মাসে কোনো যুদ্ধের সূূচনা করা যাবে না। তাফসীরের কিতাবগুলোতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন ইনশাআল্লাহ।
Assalamualaikum WRWB.
It’s better and wise to keep text within the context and avoid unnecessary details. However, I would pray to Allah SWT to give you the best reward in return.
In Shaa Allah you would benefit if you listen to deliberations of Dr. Yasir Qadhi and Dr. Omar Suleiman on the topics.
May Allah SWT guide and protect us all.
Ameen.
Thank you for your feedback.
আসসালামু আলাইকুম, ভাই! নবীজি(স:) বলেছেন মুহাররমের ১০ এর সাথে ৯ অথবা ১০ এর সাথে ১১ তারিখ রোযা রাখতে।
এটা উত্তম বলা হলো, ৯,১০,১১ তিন দিন রোযা রাখাকে অতিউত্তম! বলা হলো, বিষয়টা কেমন অদভূত লাগছে।
এটি আমার ব্যক্তিগত মন্তব্য নয়। বুখারীর বিখ্যাত ব্যাখ্যা গ্রন্থ ফাতহুল বারীতে হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (রহ) উক্ত মন্তব্যটি করেছেন। পোস্টে তাঁর বরাত দিয়েই কথাটি লিখা হয়েছে।
আসসালামুআলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। হাসান আবদুল্লাহ ভাইকে বলছি আপনি কি শরীয়তসম্মত পর্দা মেইনটেইন করে চলেন? জানার খুব আগ্রহ। দয়া করে জানাবেন।
ওয়ালাইকুমুসসালাম। ব্লগে, ইনবক্সে অনেক রকম বিচিত্র মন্তব্য আসে। আপনার মন্তব্যটি পড়ে আমি স্তম্ভিত হলাম। একই সাথে কিংকর্তব্যবিমূঢ় কয়েকটি ব্যাপারে…
প্রথমতঃ মুহাররম সংক্রান্ত পোস্টের সাথে আমার ব্যক্তিগত একটি আমলের কী সম্পর্ক থাকতে পারে তা খুঁজে পেতে আমি ব্যর্থ হয়েছি।
দ্বিতীয়তঃ পর্দার মত একটি আবশ্যিক একটি আমলের ব্যাপারে আমার অবস্থান জেনে আপনার কী ধরনের উপকার বা ক্ষতি থাকতে পারে সেটা খুঁজে পেতেও আমি ব্যর্থ হয়েছি।
তৃতীয়তঃ এরকম একটা পাবলিক প্ল্যাটফর্মে কোন সেন্সে এরকম একটা প্রশ্ন করা যায় সেটার সূত্র ধরতেও আমি ব্যর্থ হয়েছি।
যাই হোক, আপনার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। আমি ব্যক্তিগত জীবনে পর্দা মেইনটেইন করার চেষ্টা করি। এটা করার ক্ষেত্রে ভুলত্রুটি থাকতে পারে।
মাশাআল্লহ আলোচনাটি অনেক সুন্দর লাগলো আমাদের সকলকে সহি বুঝ দান করুক বেদাত কুফর শিরক থেকে বেঁচে থাকার তৌফিক দান করুক, লেখকদের জন্য দোয়া করি আল্লাহ তাদেরকে লম্বা হায়াত দান করুন।
Oneke ai mase 1st 10 din roja rakhe…ata ki sothik?
এই মাসে বেশি বেশি রোজা রাখার ব্যাপারে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। সেই হিসাবে হয়ত ১০ দিন রোজা রাখা যেতে পারে। কিন্তু ১ম ১০ দিনের রোজাকে বিশেষ ভাবে রাখা বা এটাকে বিশেষ ফজিলতের মনে করলে সেটা কনফার্ম হয়ে নিতে হবে যে, নবীজি (সা) ১ম ১০ দিনের রোজা বিশেষ ভাবে রাখতে বলেছেন কিনা বা এর বিশেষ ফজিলতের কথা উল্লেখ করেছেন কিনা। হাদীসে মুহাররমের ১ম ১০ দিন রোজা রাখাকে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে কিনা আমার জানা নাই। আলেমদের থেকে ভেরিফাই হয়ে নিতে হবে।
আলহামদুলিল্লাহ। সহীহ্ আকিদা তুলে ধরার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ ও মোবারকবাদ।
আসসালামু আলাইকুম
হাসান ভাইকে অনেক মোবারক বাদ জানাচ্ছি আলহামদুলিল্লাহ অনেক কিছু জানতে পারলাম।
তবে কার বালার ইতিহাসে যেহেতু আমরা মুসলিমগনের রক্ত করণ হয় তাই ইতিহাস টি আরো পরিপূরক করে দিবেন পরবর্তীতে ইনশাআল্লাহ।
মাশাআল্লাহ,, আল্লাহর ইচ্ছায় অনেক কিছু জানা হলো,,, এবং এই এ্যপের জন্য শুভ কামনা রইল