আমরা জানি ইসলামী জ্ঞানের সন্দেহাতীত বিশুদ্ধ উৎস কুরআন ও হাদীস। রাসূলের (সা) সাহাবীগণের আমল। এর পরবর্তী তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীগণের আমল থেকেও আমরা ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধান শিক্ষা করে থাকি। আল্লাহর রাসূল (সা) তাঁর সাহাবীগণের সময়কাল, এর পরবর্তী ও তার পরবর্তী প্রজন্মের সময়কালকে উত্তম বা পূণ্যময় সময় হিসাবে ব্যক্ত করেছেন। অন্যান্য বিষয়ের মত শবে বরাত বা লাইলাতুন নিসফ মিন শা’বানের মর্যাদা, ফজিলত ও এর সুন্নাহ নির্দেশিত আমলের জন্য আমাদেরকে ঐ তিনটি পূণ্যময় প্রজন্মের কাছে ফিরে যেতে হবে। তাঁরা এই রাত্রিকে যেভাবে গ্রহণ করেছেন, যতটুকু গুরুত্ব দিয়েছেন আমরাও তাদরে অনুসরণ করব ইনশাআল্লাহ। রাসূল (সা), তাঁর সাহাবীগণ এবং পরবর্তী প্রজন্মের তাবেয়ীগণ এই রাত সম্পর্কে যেই ধারণা পোষণ করতেন ও এই রাতে যেভাবে আমল করতেন আমাদেরও উচিত সেভাবেই তাদের অনুকরণ করা।
ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ) স্যারের রচিত “কুরআন সুন্নাহর আলোকে শবে বরাত – ফজিলত ও আমল” বইটি আমাদেরকে সেই পূণ্যবানদের পথ অনুসরণ করতে আগ্রহী ও সচেষ্ট করে। বইটি আমাদের সামনে এ রাত সম্পর্কে সত্যাসত্য উভয় বিষয়গুলো তুলে ধরে। তথ্য গোপন না করে সাদা ও কালো উভয় দিকের বক্তব্য ও তার চুলচেরা বিশ্লেষণ পাওয়া যায় বইটির পাতায় পাতায়। লেখকের অন্যান্য বইয়ের মত এই বইটিও পুরোপুরি দলিল ভিত্তিক। এমন কোনো হাদীস সম্পর্কে আমার মনে পড়ছে না যেখানে লেখক বলেছেন “হাদীস শরীফে আছে…” কিন্তু হাদীসের কিতাবের রেফারেন্স দেন নাই! তাই যারা প্রকৃত পক্ষে সফেদ অন্তর নিয়ে সত্য সম্পর্কে জানতে আগ্রহী, তারা ছোট্ট কলেবরে সাজানো এই বইটি এক বসায় পড়ে শেষ করতে পারেন।
বইয়ের বিষয়বস্তু ও অধ্যায় বিন্যাস
বইয়ের প্রথমেই শবে বরাতের পরিচয় ও এর নামের ব্যাপারে হাদীসের নির্দেশনা সম্পর্কে বলা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে। তা হচ্ছে ফজিলত ও আমলের উৎস। লেখক এখানে বলেছেন যে আল্লাহ প্রদত্ত ওহী-ই হচ্ছে কোনো বিষয়ের ফজিলতের ব্যাপারে বা কোনো বিশেষ আমলের ব্যাপারে জানার একমাত্র মাধ্যম। অর্থাৎ কোনো আমল যদি আমরা ইসলামের দৃষ্টিতে ভাল মনে করি, বা কোনো আমলকে সওয়াবের কাজ বা সুন্নাহ মনে করি। তাহলে সেই আমল সম্পর্কে ওহী’র দলিল থাকতে হবে। সেই ওহী হতে পারে কুরআন অথবা হাদীস।
তৃতীয় অধ্যায়ে শবে বরাত সম্পর্কে কুরআনে কোনো আয়াত রয়েছে কিনা সে ব্যাপারে বিস্তারিত বলা হয়েছে। লেখক এখানে দলিল দস্তাবেজ সহ দেখিয়েছেন যে কিছু মুফাসসিরগণ কুরআনের সূরা দুখানের যে আয়াতের ব্যাখ্যায় শবে বরাতকে বুঝিয়ে থাকেন সেটা আসলে সঠিক নয়। কেন সঠিক নয় সে ব্যাপারে এত চমৎকার বর্ণনা আর রেফারেন্স রয়েছে যে, যে কোনো সাধারণ বুদ্ধি ও বিবেকবান লোকই লেখকের সাথে একমত হবেন।
এরপর বইয়ের বাকি অংশে মূলত শবে বরাত বিষয়ে যতগুলো হাদীস পাওয়া যায় তার প্রায় সবগুলো পর্যায়ক্রমে উল্লেখ করা হয়েছে। লেখক এ সম্পর্কে সহীহ, যয়ীফ, জাল-বানোয়াট সহ মোট ৩৯ টি হাদীস উল্লেখ করেছেন। যা বইয়ের সূচীপত্র থেকে পাওয়া যায়। লাইলাতুন নিসফ মিন শা’বান বিষয়ে যে হাদীসগুলো পাওয়া যায় তার বিষয়বস্তুকে লেখক সাতটি ভাগে ভাগ করেছেন। সেগুলো হচ্ছেঃ
- সাধারণ ফজিলতের কিছু হাদীস। যেগুলোতে কোনো বিশেষ আমলের উল্লেখ নাই
- উক্ত রাতে হায়াত-মওত ও রিজক নির্ধারণ বিষয়ক হাদীস
- দুআ মুনাজাতে উৎসাহজ্ঞাপক হাদীস
- অনির্ধারিত ভাবে সালাত আদায়ে উৎসাহ দেয় এমন হাদীস
- নির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট সংখ্যক রাকাত সালাত আদায়ের উৎসাহজ্ঞাপক হাদীস
- সনদ বিহীন কিছু প্রচলিত বানোয়াট কথা
- সাহাবী ও তাবেয়ীগণের কিছু বক্তব্য ও আমল
বইতে উল্লেখিত ৩৯ টি হাদীস উক্ত সাতটি অধ্যায়ে সন্নিবেশ করা হয়েছে।
বইটি পড়ে যা বুঝলাম তা হচ্ছে, এ রাতের ফজিলতের ও সাধারণ ক্ষমা বিষয়ক কিছু হাদীস রয়েছে যেগুলোর বর্ণনা সূত্রকে সহীহ বা বিশুদ্ধ বলা যায়। এছাড়া বিশেষ পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট রাকাত নামাজ পড়ার যেসকল হাদীস রয়েছে সেগুলো আসলে কোনোটাই হাদীস নয়। বরং সেগুলো জাল ও বানোয়াট কথা। যা রাসূলের (সা) নামে কোনো জালিয়াত ব্যক্তি প্রচার করেছেন। একই ভাবে এ রাতে ভাগ্য নির্ধারণ হওয়া ও হায়াত-মওত নির্ধারন হওয়া বিষয়ক হাদীসের বর্ণনাসূত্রগুলোও অনেক দুর্বল। যার কারণে মুহাদ্দীসগণ ঐ কথাগুলোকে রাসূলের (সা) বাণী হিসাবে গ্রহণ করেন না।
প্রচলিত বানোয়াট কিছু বিষয়ের উল্লেখ এ বইয়ে রয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে শবে বরাতের রাতে গোসল করার বানোয়াট রীতি। হালুয়া-রুটির মিথ্যা কিসসা। শবে বরাতের পরের দিন বিশেষ ভাবে রোজা রাখার বিষয়টিকেও লেখক সনদবিহীন বানোয়াট কথা হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া বেশ কিছু প্রচলিত বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়েছেন যেগুলো বর্তমান সমাজে বানোয়াট ও মিথ্যা কথার জন্য বিখ্যাত। যেমন মোকসেদুল মোমিন ও নেয়ামুল কোরান। এরকম কিছু বইতে উল্লেখ থাকা কিছু ভিত্তিহীন মিথ্যা কথাকে তুলে ধরা হয়েছে। যেগুলোকে হাদীস বলে উল্লেখ করা হয়েছে ঐ বইগুলোতে। এমন কি জালিয়াতগণ বইতে মনগড়া কথা লিখে সেগুলোর শেষে বুখারী ও মুসলিমে আছে এমন মিথ্যা কথাও জুড়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করুন। তাদের এইসব অপকর্মগুলো থেকে মুসলিম সমাজকে রক্ষা করুন।
বইয়ের শেষের দিকে তাবেয়ীগণ ও চার ইমামের বক্তব্য ও অবস্থান সম্পর্কে সংক্ষেপে ধারণা দেয়া হয়েছে। পুরো বইয়ের হাদীসগুলোর আলোকে লেখক শেষে এসে সারসংক্ষেপ করেন এভাবে যে, এ রাতের সাধারণ ক্ষমা ও মুক্তি লাভ করা সকল মুসলিমের জন্য উন্মুক্ত। কিন্তু এগুলোর পিছনে কিছু শর্তের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হচ্ছেঃ
- বিশুদ্ধ ইমান ও ইখলাস
- সুন্নাতের অনুসরণ
- হালাল খাদ্য ও হালাল উপার্জন
- শিরক বর্জন
- হিংসা-বিদ্বেষ বর্জন
বইয়ের শেষ পৃষ্ঠাটিতে লেখক “মুমিন জীবনের প্রতিটি রাতই শবে বরাত” এই শিরোনামে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। একটি হাদীস পড়ে অনুধাবন করলেই বলতে পারি এ বইটি পড়া সার্থক!
রাসূল (সা) বলেছেনঃ
প্রতি রাতে রাতের প্রথম তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হলে আল্লাহ প্রথম আসমানে নেমে বলেনঃ
“আমিই রাজাধিরাজ! আমিই রাজাধিরাজ!! আমাকে ডাকার কেউ আছ কি? আমি তার ডাকে সাড়া দিব। আমার কাছে চাওয়ার কেউ আছ কি? আমি তাকে প্রদান করব। আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার কেউ আছ কি? আমি তাকে ক্ষমা করব!”
প্রভাতের উন্মেষ হওয়া পর্যন্ত এভাবে তিনি বলতে থাকেন।
(মুসলিম, আস-সহীহ ১/৫২২, বুখারী শরীফেও অনুরূপ আরেকটি হাদীস রয়েছে)
অর্থাৎ আমরা চাইলে আমাদের জীবনের প্রতিটি রাতকেই শবে বরাতের মত ফজিলতপূর্ণ করে তুলতে পারি। প্রতি রাতেই আল্লাহ নিজে আমাদেরকে ডাকতে থাকেন। যখন আমরা ঘুমে আচ্ছন্ন থাকি। তিনি ক্ষমা করার জন্য আমাদেরকে ডাকতে থাকেন। আমাদের জাগতিক বিষয়গুলো প্রদান করার জন্য আমাদের ডাকতে থাকেন। আমরা আমাদের রিযিক, আমাদের চাকরি, আমাদের পড়াশোনা যে কোনো কিছুই আল্লাহর কাছে চাইব প্রতিটি রাত্রে। তাহলে ইনশাআল্লাহ আল্লাহ অবশ্যই অবশ্যই তা আমাদেরকে প্রদান করবেন। কারণ এটা রাসূল (সা) থেকে থেকে প্রাপ্ত বাণী। এটা আল্লাহর ওয়াদা। আর আল্লাহর ওয়াদা অবশ্যই সত্য!
সব শেষে বলতে চাই, আমাদের জীবনের পথ চলার পাথেয় বানাতে হবে কুরআন ও হাদীসকে। ছোট বেলা থেকে আমরা হয়ত শবে বরাত বিষয়ে অনেক আমলের কথা, অনেক ফজিলতের কিসসা-কাহিনী শুনে এসেছি। বড় হয়ে, পড়াশোনা করে যদি দেখতে পাই সেগুলো কুরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত নয়। তাহলে আমরা ওগুলো ছেড়ে দিব। কারণ সুন্নাতের মধ্যেই কল্যান ও নিরাপত্তা রয়েছে। কোনো একটা কাজ আল্লাহর রাসূল (সা) করেন নাই সেই কাজটি আদতে ভালও হতে পারে আবার মন্দও হতে পারে। তাই সুন্নাহ সমর্থিত নয় এমন আমলগুলো থেকে আমরা বের হয়ে আসি। সারা জীবন চেষ্টা চালিয়েও আমরা হয়ত সহীহ সুন্নাহগুলোর উপর আমল করেই শেষ করতে পারব না। তাহলে বাড়তি এমন কাজের পিছনে সময় নষ্ট কেন করব যেগুলো সুন্নত নয়? চলুন আমাদের ঈমানের একটা পরীক্ষা করি! বাপ-দাদাদের থেকে জেনে আসা বা ছোট থেকে মেনে আসা কনসেপ্টগুলোর কোনোটা সুন্নাহর পরিপন্থি হিসাবে প্রমাণিত হলে আমরা সেটাকে বর্জন করতে পারছি নাকি আগের ভুলটাকেই যুক্তি-তর্ক ইত্যাদি দিয়ে উত্তম বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছি? এখানে আমাদের ঈমানের একটা পরীক্ষা হয়ে যায়! আমরা রাসূলকে (সা) বেশি ভালবাসি নাকি আমাদের পূর্বপুরুষদের অনুসরণ করাকে বেশি ভালবাসি? এভাবে নিজেদের ভিতরটাকে পরীক্ষা করার সময় এসেছে! আল্লাহ আমাদেরকে সকল কিছুর চেয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা) অনুসরণকে বেশি পছন্দনীয় করার তাওফিক দিন। আমীন।
বই সম্পর্কে কিছু তথ্য
নামঃ কুরআন সুন্নাহর আলোকে শবে বরাত – ফজিলত ও আমল
লেখকঃ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ)
প্রকাশনীঃ আস-সুন্নাহ পাবলিকেশন্স
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৬৪
মুদ্রিত মূল্যঃ চল্লিশ টাকা মাত্র
অনলাইনে নিয়ামাহ শপ থেকে আমি অর্ডার করেছিলাম।
আস-সুন্নাহ ট্রাস্টের অফিসিয়াল সাইট থেকে বইয়ের পিডিএফ পড়তে পারেন।
আল্লাহ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যারকে জান্নাতের উচ্চ স্থান দান করুন। এই বইয়ের প্রকাশের সাথে যারা জড়িত সকলকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। আমরা যারা বইটি পড়েছি বা রিভিউ পড়লাম, তাদেরকে আল্লাহ এর উপর আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।