মাস তিনেক আগে পছন্দের যেই পোলো শার্ট বা পাঞ্জাবিটা টাইট হয়ে যাওয়ায় বাদ দিব ভেবেছিলাম। সেই জিনিসই আজ মনে হচ্ছে খানিকটা চাপিয়ে পরলে গায়ে ভাল মানাতো। এই অনুভূতিটা কেমন কল্পনা করতে পারেন? যেহেতু আপনি পোস্টের টাইটেলটা পড়ে নিজ ইচ্ছাতেই আমার গল্প শুনতে এসেছেন তাই ধরেই নিচ্ছি আপনিও মাঝেমধ্যে একটু আধটু অমন স্বপ্ন দেখেই থাকেন। নইলে ওজন কমাবার পোস্টে আপনার আগ্রহ থাকতই না!
বিরাট গল্প ফেঁদে বসার আগে দুই ধরনের পাঠককে সময় নষ্ট করা থেকে বাঁচিয়ে দিতে একটা কথা না বললেই নয়। যারা ডাক্তার জাহাঙ্গীর কবিরের নাম শুনলেই ঠোঁট বাকিয়ে, মুখ কুঁচকে তার প্রতি বিরক্তিতে নিজের মনতে বিষিয়ে তোলেন। তারা পোস্টটা এড়িয়ে যেতে পারেন। কারণ আমি ডাক্তার জাহাঙ্গীর কবিরের ইউটিউবে দেখানো লাইফ স্টাইল ফলো করেই ওজন কমিয়েছি। যদি তার প্রতি আপনার যৌক্তিক বা অযৌক্তিক কোনো কারণে অ্যালার্জি থাকে তাহলে আপনি পোস্টটি ইগনোর করতে পারেন। আর দ্বিতীয় গ্রুপ হচ্ছে যারা ডাক্তার সাহেবের ফ্যান। বা তার পদ্ধতি সম্পর্কে জানেন বা ইতমধ্যে মানা শুরু করেছেন। কারণ আপনি নিজেই জানেন কী পদ্ধতি বা কী রকম লাইফ স্টাইল তিনি লিড করতে বলেন। তাই এই পোস্টে আপনার জন্য নতুন কোনো তথ্যই হয়ত থাকবে না। আল্লাহর দেয়া সবচেয়ে বড় নিয়ামত আমাদের সময়। যদি মনে করেন সময় নষ্ট হওয়ার আশংকা আছে, তাহলে এড়িয়ে যান।
আমি ডাক্তার জাহাঙ্গীর কবির স্যারের ইউটিউব ভিডিওর পরামর্শ অনুযায়ী লাইফ স্টাইলকে পরিবর্তন করে ৪৮ দিনে প্রায় ৭ কেজি ওজন কমিয়েছি। এই ৪৮ দিনের আগের দুই-আড়াই মাসে কমিয়েছিলাম চার কেজি ওজন। অর্থাৎ মোটের উপর আমি তিন থেকে সাড়ে তিন মাসের প্রচেষ্টায় আল্লাহর ইচ্ছায় ১১ কেজির মত ওজন কমিয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ। এই লেখায় এই পুরো তিন মাসের জার্নিটাই আমি তুলে ধরার চেষ্টা করব। প্রথম দেড় মাস ও পরের দেড় মাসের লাইফ স্টাইল আলাদা ভাবে উল্লেখ করব। হয়ত এতে অনেকেই অনুপ্রাণিত হবে একটা হেলদি লাইফস্টাইল লিড করার জন্য। তারা আরো বিস্তারিত জানার জন্য ডাক্তার সাহেবের ইউটিউবের চ্যানেলে কিছু সময় দিতে পারেন। ইনশাআল্লাহ আপনি কয়েক দিন চ্যানেলটায় ঘুরাঘুরি করতে থাকলে বুঝে ফেলবেন কোথা থেকে শুরু করতে হবে। তাহলে চলুন শুরু করা যাক আমার তিন মাসের গল্প…
প্রথম দেড় মাস
ডিসেম্বর ২০১৯ এর শুরুর দিককার কথা। এই সময়টায় আমার মাথায় কোনো পরিকল্পনাই ছিল না ওজন কমানোর। খুব সম্ভবত এ সময়ে ডাক্তার জাহাঙ্গীর কবিরের নামও আমি শুনি নাই। কিন্তু এই দেড়-দুই মাসেও আমার ওজন প্রায় চার কেজি কমেছে। এই সময়ে আমি আলাদা কোনো এক্সারসাইজ বা বিশেষ খাবার খেতাম না। রাসূলের (সা) একটা সুন্নাহ পালনের নিয়ত করি। যদিও ব্যক্তিগত আমলের কথা কাউকে জানানো উচিত না। তাও এটার সাথে যেহেতু ওজন কমার একটা সম্পর্ক আছে তাই বৃহত্তর স্বার্থে শেয়ার করতে হচ্ছে। বেশ কিছু হাদীস পড়ি ও বিভিন্ন কারণে আমি উদ্বুদ্ধ হই। মনে মনে নিয়ত করে ফেলি আল্লাহ যত দিন বাঁচিয়ে রাখবেন সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাব সারা জীবন সপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখব। একই সাথে আরবি মাসের ১৩, ১৪ ১৫ এর আইয়ামে বীজের রোজা রাখব। ধর্মীয় কারণেই আমি এই সিদ্ধান্ত নিই। ওজন কমানোর কোনো চিন্তা তখনও মাথায় ছিল না। ৪ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে আমার ওজন ছিল ৭৪ কেজি। আমার হাইট ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি হওয়ায় ৫৮ থেকে ৬০ কেজি আমার ওজন হওয়া উচিত। তাও ৭৪ কেজি ওজনকে এমন কোনো বেশি ওজন মনে হত না।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে আমি রোজা রাখা শুরু করি। সাহরিতে ভাত তরকারি খেতাম। তবে গলা পর্যন্ত ভর্তি করে খেতাম না। রমজান মাসে আমরা রোজা রেখেও রোজার সব রকম স্বাস্থ্যগত সুবিধা থেকে আমরা বঞ্চিত হই সাহরিতে গলা পর্যন্ত খেয়ে। আর ইফতারে বিষাক্ত খাবার আরো বেশি পরিমাণে খেয়ে। তো আমি সাহরিতে পরিমাণ মত খেতাম। আর ইফতারে আধা প্লেট ভাতের সাথে সবজি-সালাদ বেশি খেতাম। সাথে মাছ বা গোশত থাকত। অফিস থেকে দুপুরের খাবার দেয়া হয়। সেটা ফ্রিজে রেখে দিয়ে ইফতারের সময় খেতাম। সাহরি ও ইফতারের সময়সূচী রমজান ছাড়া অন্য সময়ে নির্ভুল ভাবে পাওয়া ঝক্কির কাজ। সেটা থেকে পাঠকদের মুক্তি দিতে পারে আমার টিম নিয়ে ডেভেলপ করা Muslims Day – মুসলিমস ডে এই Android অ্যাপটি। আমি এই অ্যাপের মাধ্যমেই নফল রোজার সাহরি ও ইফতারের সময় দেখে থাকি। বিশ্বের যে কোনো স্থান থেকে সারা বছরের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, নফল নামাজ ও সাহরি ইফতারের সময় জানার জন্য অ্যাপটি গুগল প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করে নিতে পারেন।
প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, আমি ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত রেগুলার সাইক্লিং করে কমিউট করি। বর্তমানে সপ্তাহে ৫ দিন বাসা থেকে অফিসের আপ-ডাউন সাইক্লিং করা হয় ১৮ কিলোমিটারের মত। সাইক্লিং ছাড়া এই দেড় মাসে বাড়তি কোনো শরীর চর্চা আমি করি নাই। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত – সারা বছরই আমি সাইক্লিং করি। অভ্যাস হয়ে যাওয়ায় রোজার সময়ও সাইক্লিং করা কোনো বাড়তি কষ্টের কাজ মনে হয় না। বরং এ কথা মনে হলেই শিউরে উঠি সাইকেলে যে পথ যেতে আমার ৩৫ মিনিট লাগবে, বাসে গেলে লাগবে অন্তত দেড় ঘন্টা!
যাই হোক, এভাবে সপ্তাহে দুইটা রোজা আর আরবি মাসের হিসাবে ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ এই রোজাগুলো রাখতে থাকলাম। ইফতারে ভাত কমিয়ে সবজি-সালাদ বেশি খেতাম। রাতে বাসায় এসে আবার অল্প কিছু খেয়ে নিতাম। রোজার সুন্নাতের পাশাপাশি অনেক আগে থেকেই আরেকটা সুন্নাহ অনুসরণ শুরু করি। তা হচ্ছে পেট ভরে খাবার না খাওয়া। এই দেড় মাস এটা আরেকটু সিনসিয়ারলি করা শুরু করি। রাসূলের (সা) একটা হাদীসের ভাবার্থ এরকম “সবচেয়ে নিকৃষ্ট পাত্র হচ্ছে ঐ পেট যা খাবার দ্বারা পরিপূর্ণ করা হয়”। অর্থাৎ পেট ভরে খাওয়াকে আল্লাহর রাসূল (সা) কতটা ঘৃণা করতেন। আমরা অপ্রয়োজনে পেট ভরে খাওয়ার কারণেই আমাদের এত ধরণের স্বাস্থ্যগত সমস্যা। ইসলাম যেখানে কম খাওয়াকে রিকমেন্ড করেছে, আমরা সেখানে এখন প্রতিযোগিতা করি মিনিটে কয়টা বার্গার খাওয়া যায়। ১ ঘন্টায় কয়টা পিৎজা খাওয়া যায়। ভোগবাদী আর পুঁজিবাদী সমাজের গোলামী আর তাদের অন্ধ অনুকরণই যেন এখন আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।
তো যাই হোক, এভাবে রোজা রেখে আর একটু মেপে খাবার খেয়ে দেখলাম মাস দেড়েকের মধ্যে আমার ওজন ৭৪ কেজি থেকে ৭০ কেজিতে এসে ঠেকেছে। ঐ সময়টা অবশ্য জীবনের সব চেয়ে কঠিনতম সময় পার করছিলাম কিছু ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ব্যাপার নিয়ে। তার আগের পরের মিলিয়ে ৬-৮ মাস জীবনের সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা আর স্ট্রেসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এজন্যও ওজনের উপর এর কিছু প্রভাব পড়তে পারে। এভাবে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস শেষ হলো।
জানুয়ারির মাঝামাঝির দিকে আম্মুর থেকে সম্ভবত প্রথম ডাক্তার জাহাঙ্গীর কবিরের কথা শুনি। আম্মু ইউটিউবে ঘুরতে ঘুরতে ডাক্তার সাহেবের ভিডিও পান। এরপর শুরু করেন ভিডিওগুলোর উপর বিস্তর রিসার্চ। রীতিমত খাতা-কলম নিয়ে বসে ভিডিও pause দিয়ে দিয়ে টুকে রাখত ডায়েট প্ল্যান সহ প্রয়োজনীয় যত তথ্য। এরপর তিনি জানালেন ডাক্তার সাহেবের ইউটিউবের ভিডিওতে দেয়া পরামর্শ মেনে তিনি পুরো লাইফ স্টাইল চেঞ্জ করে ফেলতে চান। প্রথমে একবার বলার পরেও তেমন পাত্তা দেই নাই। পরে দেখলাম আম্মু বেশ সিরিয়াস। এরপর আমি ডাক্তার সাহেবের কয়েকটা ভিডিও দেখলাম। এরপর ডায়েট রিলেটেড যা যা কেনা দরকার সেগুলো কেনার ব্যবস্থা করে ১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ থেকে নতুন ভাবে জীবন চালানো শুরু করলাম।
দ্বিতীয় দেড় মাস
১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ইং তারিখ থেকে আমি আর আম্মু ভাত, রুটি, আলু, চিনি অর্থাৎ সরাসরি শর্করা জাতীয় সকল খাবার খাওয়া বন্ধ করে দেই। শুধু শাক-সবজির মাধ্যমে যতটুকু শর্করা খাওয়া হত ওটুকুই। বিস্কুট-চানাচুর, ফাস্টফুড, কেক অর্থাৎ যত ধরনের প্রসেসড ফুড আছে বাকি জীবনের জন্য এসব খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। এই সময়ে ডাল খেতেও ডাক্তার সাহেব নিষেধ করেছেন। ফলের মধ্যে চিনি থাকায় এই দেড় মাস ফলমূলও এড়িয়ে গেছি। বাসায় রান্নার তেল বদলে ফেলি। সয়াবিন তেলের পরিবর্তে সরিষার তেল ও যায়তুনের তেল (এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল) দিয়ে রান্না করা শুরু করি। যায়তুনের দাম বেশি হওয়ায় সরিষার তেলই মূলত ইউজ করা হয়। আধা লিটার যায়তুনে দেড় দুই মাস কভার করে ফেলেছি অল্প অল্প করে খেয়ে। রান্না আর খাবারে আগের সাথে মূল পার্থক্য এগুলোই। নতুন লাইফ স্টাইলের এই দেড় মাসকে ২ ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথম সপ্তাহ ও পরবর্তী সময়কাল।
প্রথম সপ্তাহ – শরীরকে ফ্যাট বার্ন করতে প্রস্তুত করা
ডাক্তার জাহাঙ্গীর কবির সাহেবের কথা হচ্ছে শরীরে জমে থাকা বাড়তি ফ্যাট বার্ন করা। ওজন কমানো উদ্দেশ্য নয়। ওজন কমানো আর ফ্যাট বার্ন করার মধ্যে তিনি পার্থক্য করেন। তিনি বলেন মাসল বা মাংসপেশীর কারণে ওজন বেশি হলে সেটা সমস্যা না। সমস্যা হচ্ছে চর্বির কারণে ওজন বেশি হলে। তাই আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে শরীরে জমে থাকা চর্বি গলানো এবং নতুন মাংসপেশী গঠন করা। সেজন্য তার পরামর্শ অনুযায়ী চললে কারো হয়ত ১০ কেজি চর্বি গলে ২ কেজি মাসল বিল্ড হবে। এতে তিনি দেখবেন তার ওজন ৮ কেজি কমেছে। আবার অন্য কারো ক্ষেত্রে হয়ত ৫ কেজি চর্বি গলেছে আর ৫ কেজি মাসল বিল্ড হয়েছে। এতে তিনি দেখবেন গড়ে তার ওজন কমেছে মাত্র ৫ কেজি। তাই নিজের শরীর সম্পর্কে নিজেকে বুঝতে হবে যে আমার শরীরের কোথায় কী পরিমাণ চর্বি আছে। আর আমি সেগুলোর কতটা ঝড়িয়ে ফেলতে চাই।
আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে শরীরে জমে থাকা চর্বিগুলো আমাদের ব্রেইনকে চিনিয়ে দেয়া। এই চর্বি দেহে জমা হয়েছে আমাদের তিন বেলা ভাত-রুটি বা শর্করা জাতীয় খাবার বেশি খাওয়ার কারণে। আমরা যা-ই খাই শেষ পর্যন্ত দেহে যতটুকু শক্তি দরকার তা বাদে বেশির ভাগ অংশই চর্বি হিসাবে জমা হয়। দেহ চর্বি জমা করে রাখে দুর্ভিক্ষের সময় যেন সারভাইভ করা যায় সেজন্য। তাই আমাদের ডেইলে লাইফে পরিবর্তন না আনলে এই চর্বি স্বাভাবিক ভাবে বার্ন হয় না। আমাদের দেহের চর্বি যেন বার্ন হওয়া শুরু হয় সেজন্য ৭-১০ দিনের একটা টাইম পিরিয়ড পার করতে হয়েছে।
এই সময়ে আমরা শুধু শাক-সবজি, মাছ-গোশত আর প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাওয়া গুড ফ্যাট খেয়েছি পর্যাপ্ত পরিমাণে। বলা চলে পেট ভরে এসব খাবার খেয়েছি। ভাল চর্বিগুলো দেহের জন্য উপকারী। তো আমরা যখন আমাদের খাবারের মেনুর প্রায় ৭০ ভাগ ভাল চর্বি রেখেছি তখন বডিকে এই চর্বি থেকে শক্তি উৎপন্ন করে চলতে হচ্ছে। পাশাপাশি তার ফ্যাট বার্ন করার একটা প্র্যাক্টিস শুরু হচ্ছে। এভাবে আমরা ১ সপ্তাহ পার করেছি। এরপর মোটামুটি বুঝতে পেরেছি আমাদের দেহ বলা চলে তার বেশির ভাগ শক্তিই পাচ্ছে আমাদের শরীরে জমে থাকা চর্বি থেকে। তখন আমাদের খাবার স্টাইলে আরেকটু পরিবর্তন নিয়ে আসতে হয়েছে।
নিচে এই এক সপ্তাহে আমরা কী কী খাবার কিভাবে কখন খেয়েছি তা তুলে ধরা হলো।
ঘুম থেকে ওঠা – নামাজ, এক্সারসাইজ, শরীরে রোদ লাগানো ও সকালের নাস্তা
ডাক্তার জাহাঙ্গীর কবিরের নির্দেশনা হচ্ছে ফজরের সময় ঘুম থেকে উঠতে হবে। নামাজ পড়ে আর ঘুমানো যাবে না। বাইরে আধা ঘন্টা হাঁটতে হবে বা দৌঁড়াতে হবে। এক্সারসাইজ করতে হবে। শরীরে ৩০ মিনিট সূর্যের আলো লাগাতে হবে। আগে ফজরের পর কম-বেশি ঘুমানো হত। এই সময় এক রকম স্ট্রিক্টলি ফজরের পর ঘুমানো বন্ধ করে দিলাম। নামাজের পর প্রথম এক সপ্তাহ হাঁটতাম আর রেস্ট নিয়ে নিয়ে দৌঁড়াতাম। ১৫-২০ সেকেন্ড দৌঁড়াতে পারতাম। ১৫-২০ সেকেন্ড দৌঁড়িয়ে ১০-১৫ সেকেন্ড রেস্ট নিতাম। এভাবে ৪-৫ মিনিট দৌঁড়াতাম। হাঁটা দৌঁড়ানো মিলে ২০ মিনিট সময় ব্যয় করতাম। আস্তে আস্তে চেষ্টা করেছি দৌঁড়ানোর duration বাড়ানোর জন্য। দেড় মাস পর বর্তমানে আমি আল্লাহর রহমতে এক টানা ২০ মিনিট দৌঁড়ে ৩ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করতে পারি। আলহামদুলিল্লাহ! যা আগে কল্পনাও করতে পারতাম না।
২০ মিনিট বাইরে হাঁটাহাঁটির পর বাসায় এসে ১০-১৫ মিনিট ২-৩ রকমের স্ট্রেচিং করতাম। এরপর একটু রেস্ট নিয়ে ২-১ গ্লাস পানি পান করতাম। এরপর পড়াশোনা বা অন্যান্য কাজকর্ম যা ইচ্ছা করা হত। পরে অফিসে যাওয়ার সময় প্রায় ৯ কিলোমিটার সাইকেল চালানো তো আছেই!
প্রথম ২-৩ দিন সকালে নাস্তা করতাম ৯টার দিকে। ৫-৬ টা কুসুম সহ ডিম খেতাম। কুসুম প্রাকৃতিক আর ভাল চর্বির উৎস। ৩-৪ টা ডিম পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে ভাজা হত খাঁটি ঘি দিয়ে। ঘি দিয়ে ভাজা ডিমের চেয়ে মজার জিনিস আর কী হতে পারে? ২-১ টা ডিম খেতাম সেদ্ধ করে। যায়তুন ও সরিষার তেল দিয়ে শাক-সবজি আধা সেদ্ধ করে রান্না করে খেতাম পেটে যতটুকু জায়গা হয়। সাথে থাকত শসা-টমেটোর সালাদ। সালাদেও যায়তুনের তেল খেতাম। ৫-৬ টা করে ডিম সকালে ২-৩ দিন পর্যন্ত খাওয়া যায়। এরপর আর খেতে ইচ্ছা করে না। তখন পরিমাণ কমিয়ে দিতে হয়। চর্বির বৈশিষ্ট্যই এরকম। ভাত যেমন এক গামলা খাওয়া যায়, চর্বিযুক্ত খাবার এত খাওয়া যায় না। “মুখ মেরে আসে” এমন একটা কথা আছে না? ঐ ঘটনাই ঘটে।
২-৩ দিন যাওয়ার পর নাস্তা করার সময়টা আস্তে আস্তে পেছানো শুরু করলাম। ১০ টায়, ১১ টায় এরপর অফিসে সবজি নিয়ে যাওয়া শুরু করলাম। দুপুরে লাঞ্চের সময় আমার ব্রেকফাস্ট ও লাঞ্চ হয়। অর্থাৎ শরীরকে আস্তে আস্তে না খেয়ে থাকা, আর জমে থাকা ফ্যাট বার্ন করা শিক্ষা দেয়ার কাজটাই চলছিল।
সকালের নাস্তা পেছাতে পেছাতে যখন নিয়মিত তা দুপুরে খাওয়া হয়। তখন দুপুর পর্যন্ত না খেয়ে থাকলে কম-বেশি ক্ষুধা লাগে। এজন্য সকালে পানি খাওয়ার ঘন্টা খানেক পর গ্রিন টি খেতাম (বলার অপেক্ষা রাখে না, অবশ্যই দুধ চিনি ছাড়া)। গ্রিন টি খাওয়ার ২-১ ঘন্টা পর আবার ক্ষুধা লাগলে খেতাম বুলেট কফি। দুধ-চিনি ছাড়া কফি বীন, বাদামের গুড়া, মাখন, এক্সট্রা ভার্জিন নারিকেল তেল ইত্যাদি দিয়ে আম্মু বানিয়ে দিতেন। ইউটিউব দেখে শিখেছেন এটা বানানোর রেসিপি। এমন কি নারিকেল তেলও আম্মু বাসায় বানিয়েছিলেন। পরে খাসফুড থেকে কিনে এনে দিয়েছি। কফি খেলে ক্ষুধা মোটামুটি চলে যায়। তাও ক্ষুধা লাগলে ২-১ মুঠ চীনা বাদাম খেতাম। যা ভাজা হত মাখন দিয়ে। আম্মু খাটি দুধ থেকে বাসায় মাখনও বানিয়েছিল। মাখন শেষ হয়ে গেলে ঘি দিয়ে ভাজা হত। অফিসে একটা বক্সে করে নিয়ে যেতাম। ক্ষুধা লাগলে মাঝে মাঝে খেতাম। সকালে পানি, গ্রিন টি, বুলেট কফি খাওয়ার পর দুপুর ২টা পর্যন্ত আর আসলে বাদাম বা অন্য কিছু খাওয়া ক্ষুধা লাগেই না।
আর আমি যেহেতু আগের দেড় মাস সপ্তাহে ২ টা করে রোজা রেখেছি এটা আমাকে অনেক বেশি সাহায্য করেছে। না খেয়ে থাকার তেমন কোনো কষ্টই আমার হয় নাই। তাই যদি কেউ এই পদ্ধতিতে ফ্যাট বার্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন তাহলে শুরু করার আগে কয়েক সপ্তাহ ব্যাপী সপ্তাহে ২-৩ টা করে রোজা রাখতে পারেন। তবে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা শুরু করলে প্রথম ৭-১০ দিন রোজা রাখা যাবে না। প্রথম এই সময়টা পর্যাপ্ত খাবার খেতে থাকতে হবে।
দুপুরের খাবার
বাসা থেকে সবজি নিয়ে যেতাম অফিসে। সাথে কখনো কখনো একটা শসা বা টমেটো। আর অফিস থেকে নিতাম শুধু মাছ-গোশত যা থাকত সেটা। কোনো ঝোল, তেল বা ডাল নিতাম না। সবজি-সালাদ-মাছ/গোশত খাওয়া হত। অফিসের সবজি খেতাম না, কারণ সয়াবিন খেতে ডাক্তার সাহেব নিষেধ করেছেন। শুধু যারা ডায়েট করবেন বা ওজন কমাতে চান তাদের জন্যেই না। সবার জন্যেই সয়াবিন তেল ক্ষতিকর। তাই সুস্থ্য থাকার উদ্দেশ্যে জীবন থেকে সয়াবিন তেলকে সরিয়ে দিয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ।
সন্ধ্যায় অফিস থেকে স্ন্যাক্সের ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু আমাদের নতুন লাইফ স্টাইল অনুযায়ী স্ন্যাক্সের বেশির ভাগ আইটেমই বাজে খাবার। যদিও তা আগে খুব মজা করে খেতাম। পাশের জন না খেলে সেটা খিয়ে নিতাম। ভাজা পোড়া, মোগলাই, মিষ্টি-বাকরখানি, স্যান্ডউইচ-কোক, বাটারবান, পুডিং, ফ্রুটস ইত্যাদি। তাই সন্ধ্যায় অফিসের থেকে কিছু খাওয়া হয় না। বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া বাদাম খাই। শুধু চীনা বাদাম খেতে অনেক সময় একঘেয়ে লাগতে পারে। তাই সাথে কিছু কাঠবাদাম আর কাজু বাদাম মিশিয়ে নেয়া যায়।
রাতের খাবার
রাত ৮টায় রাতের খাবার খাওয়ার কথা থাকলেও আমার ৯-১০টা বাজে অফিস শেষ করে বাসায় এসে খেতে বসতে। শাক-সবজি, সালাদ, তৈলাক্ত মাছ, তৈলাক্ত গোশত এগুলো খাওয়া হয় রাতে। প্রথম এক সপ্তাহ আমরা গরুর পায়া কিনে এনে নিহারী রান্না করে খেয়েছিলাম। কারণ এই এক সপ্তাহ হচ্ছে বেশি বেশি প্রাকৃতিক চর্বি খাওয়ার সপ্তাহ। গরুর গোশত, মুরগির গোশত, টার্কির গোশত এগুলো বেশি পরিমাণে খেতে হয় এ সময়ে। যদিও রাতে পেট ভরে খেতাম না। যেন ১১টায় ঘুমাতে যাওয়ার সময় পেট পুরো ভরা না থাকে। ডাক্তার সাহেব বলেন ১০টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে। কিন্তু আমার ঘুমাতে ঘুমাতে ১১ টা থেকে সাড়ে ১১ টা বাজে।
চর্বি বার্ন করার এই প্রসেসের জন্য deep sleep খুব জরুরি। স্বপ্নহীন গভীর ঘুম হলে এই ঘুমের মধ্যে চর্বি ভাঙ্গার কাজ হয়ে থাকে। সকালে যেই এক্সারসাইজ করেছি, সেটার ফলে গভীর ঘুম হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আর পরদিন ফজরে যেহেতু উঠতেই হবে তাই আগে আগে না ঘুমাতে গেলেও উপায় নাই। এই ফ্যাট বার্নিং প্রসেস চলার জন্য বা সুস্থ্য থাকার জন্য ডাক্তার সাহেব ৭-৮ ঘন্টা লম্বা ঘুমের পরামর্শ দেন।
পরবর্তী ৪০ দিন – water fasting ও রোজা
এই প্রকৃয়া শুরুর ৭-১০ দিন শরীর মোটামুটি ওয়াটার ফাস্টিং বা রোজা রাখার জন্য তৈরি হয়ে যায়। অর্থাৎ শরীর ফ্যাট বার্ন করে চলার মত সক্ষমতা বা অভ্যাস তৈরি করে নিয়েছে।
৭-১০ দিন পার হওয়ার পর আমরা এখন পর্যন্ত যেটা মেইনটেইন করছি তা হল সকালের নাস্তা আমরা বাদ দিয়ে দিয়েছি। দুপুরে খাই আর রাত্রে খাই। দুপুর পর্যন্ত শুধু পানি বা লিকুইড খাওয়া হয়। অ্যাপল সিডার ভিনেগার খাওয়া যায়। যদিও ভিনেগার খাই সাধারণত ডিনারের আগে। আম্মু ইউটিউব দেখে বাসাতেই এটা বানিয়েছেন।
যেহেতু দুপুর পর্যন্ত শুধু লিকুইড বা পানি খেয়ে থাকা হয় তাই এটাকে ওয়াটার ফাস্টিংও বলে। দুপুরে আগের মতই সবজি-সালাদ-মাছ/গোশত খাই। রাতেও একই রকম। সন্ধ্যায় মাখন দিয়ে ভাজা বাদাম খাই।
আর রোজা রাখলে নরমাল রোজা যেভাবে থাকি অর্থাৎ পানিও খাওয়া যাবে না সেভাবে রোজা রাখি। যেহেতু ফ্যাট বার্ন করার ইচ্ছা রয়েছে তাই এই সময়টাতে রোজার পরিমাণ একটু বাড়িয়ে দেই। সপ্তাহে ২টার জায়গায় ৩-৪ রাখি। সপ্তাহে অন্তত ২টা রোজা রাখা হয়েছেই। আর রোজার ক্ষেত্রে সাহরিতে খাওয়া যাবে শুধু ২ গ্লাস পানি। একটু লবণ দিয়ে ২ গ্লাস পানি খেতাম। অথবা এক গ্লাস পানি, এক গ্লাস ডাবের পানি খাওয়া হয়। আর যেদিন রোজা রাখি না সেদিন দুপুর পর্যন্ত শুধু পানি, গ্রিন টি আর বুলেট কফি খাওয়া হয়।
প্রথম সপ্তাহের তুলনায় এ সময়ে অত বেশি ফ্যাট খাওয়া হয় না। বডি তার ভিতর জমা করা ফ্যাট বার্ন করে শক্তি উৎপন্ন করে থাকে। ফলে আগের দিন রাত ৮টা ৯টায় খেয়ে পরদিন দুপুরে ভারি খাবার খাওয়া হচ্ছে। কিন্তু কখনোই আল্লাহর রহমতে মাথা ঘুরানো, দুর্বল লাগা, ঝিমুনি আসা কাজ করে নাই। পেট খালি থাকায় বডি বাধ্য হয়ে শরীরে জমে থাকা চর্বি ভাঙতে থাকে। ফলে ৪৮ দিনের মধ্যে পরের এই ৪০ দিনেই আমার প্রায় ৫-৬ কেজি ওজন কমেছে।
এই সময়ে সাইক্লিংয়ের পরিমাণ অপরিবর্তিত ছিল। এটা আগামীতেও একই পরিমাণ থাকবে ইনশাআল্লাহ। শুধু সকালে দৌঁড়ানোর স্ট্যামিনা আল্লাহর রহমতে বেড়ে যাওয়ায় সকালে ২০ মিনিট টানা দৌঁড়ানোটা যুক্ত হয়েছে। এটাও অনেক বেশি ফ্যাট বার্ন করতে সাহায্য করে।
এই ছিল মোটামুটি আমার ৩ মাসের জার্নি। প্রতি সপ্তাহের শুরুতে অফিসে এসে ওজন মেপে একটা গুগল শিটে লিখে রাখতাম। ৫ ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে ২২ মার্চ ২০২০ ইং তারিখ পর্যন্ত আমার ওজনের এরকম একটা গ্রাফ পাওয়া গেছে। ৭৪ কেজি থেকে ৬২.৯ কেজি।
এই ৪৮ দিনের মধ্যে একবারের জন্য আমি ভাত, রুটি বা আলু খাই নাই। কাজিনের বাসায় প্রায় ৩০০ মানুষের একটা অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে কয়েকটা ব্যাচকে বিরানী সার্ভ করেছি। কিন্তু গোশত ছাড়া কোনো রাইস খাই নাই। শুধু মনকে দমন করতে না পেরে ২ চা চামচ পায়েশ খেয়েছিলাম! 😛 আর একদিন খুব কাছের ছোট ভাই কাম স্টুডেন্টের বাসায় গিয়ে গোটা দেড়েক মিষ্টি আর এক পিরিচ দৈ খেয়েছিলাম। এই খেয়ে অনুশোচনা হয়েছে অনেক। পরে সম্ভবত ২-১ দিন একটু বেশি এক্সারসাইজ করেছিলাম।
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে কী খাওয়া যাবে আর কী খাওয়া যাবে না?
খাবারগুলোকে ৩টা ভাগে ভাগ করতে পারি।
- লক্ষ্য অর্জনের আগে যেগুলো বর্জন করে, পরবর্তীতে পরিমাণ মত খাওয়া যাবে
- যে খাবারগুলো পরিমাণ মত সব সময়ই খাওয়া যাবে
- যে খাবারগুলো কখনোই খাওয়া উচিত নয়
লক্ষ্য অর্জনের আগে যেগুলো বর্জন করে, পরবর্তীতে পরিমাণ মত খাওয়া যাবে
- ভাত
- রুটি
- আলু
- ডাল
- ফলমূল
- দুধ
- মধু
যে খাবারগুলো পরিমাণ মত সব সময়ই খাওয়া যাবে
- শাক
- সবজি
- সালাদ
- মাছ
- গোশত
- বাদাম
- দুধ চিনি ছাড়া চা-কফি
- যায়তুনের তেল
- এক্সট্রা ভার্সিন নারিকেল তেল
- ডাবের পানি
- ঘি
- মাখন
যে খাবারগুলো কখনোই খাওয়া উচিত নয়
- চিনি ও চিনিযুক্ত যে কোনো খাবার
- দুধ চিনি দিয়ে চা, কফি (কনডেন্সড মিল্ক হলে তো কথাই নাই!)
- সয়াবিন তেল বা এ জাতীয় সকল তেল যেগুলো অনেক কেমিকেলের মাধ্যমে প্রসেস করে বানানো হয়
- বিস্কুট-চানাচুর, চিপস, কেক
- কোল্ড ড্রিংক্স, দেশে ফলের জুস নামে যেই রঙীন পানি পাওয়া যায় সব
- ফাস্টফুড
- হোটেলের ভাজা-পোড়া আইটেম (যেই বিষাক্ত খাবারগুলো ছাড়া আমাদের রোজার ইফতারি পরিপূর্ণ হয় না)
- রেস্টুরেন্টের বাহারি খাবার
- পাকস্থলি পরিপূর্ণ করে যে কোনো খাবার খাওয়াই অনুচিত
ওজন কমা ছাড়াও আর কী পেলাম?
আমার প্রথমে ওজন কমানোর চিন্তাই তো আসে নাই। আম্মু শুরু করবেন। তাই আম্মুর সাথে সঙ্গ দিব বলে আমার শুরু করা। আম্মু তাহলে কেন শুরু করতে চেয়েছিলেন? আম্মুর ওজন বেড়ে গিয়েছিল। সিঁড়ি ভেঙে ৬তলায় উঠে অনেক বেশি হাপিয়ে উঠতেন। বাসার সব কাজের দায়িত্ব তার উপর। কিছুক্ষণ কাজ করেই হাপিয়ে উঠে শুয়ে পড়তে হত। রাত্রে শ্বাস কষ্টের সমস্যা হত। শোয়া থেকে উঠে বসে থাকতে হত। এছাড়াও বয়সের স্বাভাবিক সমস্যাগুলো ছিল। এগুলোর জন্য ডাক্তার সাহেবের কথা অনুযায়ী তিনি তার ওজনকেই দায়ী করেছিলেন। আর বাধ্য হয়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ফ্যাট বার্ন করার। আম্মুর বয়সী অন্যান্যরা হয়ত এই পদ্ধতির কথা শুনলে প্রথমেই ঠোঁট বাঁকা করবে। “কত কিছু দেখা লাগবো আর জীবনে…” এই বলে এক ফুঁৎকারে সব উড়িয়ে দিতে চাইবে অনেকেই। কিন্তু আল্লাহর রহমতে শিক্ষিত আর নিজেকে সংস্কার করার মানসিকতা থাকায় তিনি অসংখ্য তরুণ যুবাদের মত এই পদ্ধতিকে গ্রহণ করেছেন। আল্লাহর রহমতে তিনি এখন প্রায় অনেকখানিই ভাল আছেন। অনেকখানিই তার ওজন কমেছে। আগের মত ক্লান্তি, শ্বাস কষ্ট এসবের সমস্যা আল্লাহর রহমতে আর নাই।
বাসায় সদস্য ৫ জন। আব্বু-আম্মু, আমি আর ছোট দুই ভাই বোন। আব্বুও কিছুদিন আগে এই পদ্ধতি শুরু করেছেন। আব্বুর টাইপ টু ডায়াবেটিস। ডাক্তার জাহাঙ্গীর কবিরের মতে এটা ওষুধ ছাড়াই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব শর্করা জাতীয় খাবার না খেয়ে। আব্বু সম্ভবত ১৫ দিন হল ডায়াবেটিসের ওষুধ খাচ্ছেন না। ইনসুলিন নিচ্ছেন না। ৫ জনের মধ্যে ৩ জন আমরা এই প্রসেসে আছি। রান্নার তেল সয়াবিন থেকে আস্তে আস্তে সরিষার তেলে কনভার্ট হয়েছে। বাকিরাও সেটায় অভ্যস্থ হয়ে গেছে।
আমি পারসোনাল্যি যেরকম ফীল করছি তা হচ্ছে, আগের চেয়ে অনেক বেশি এনার্জিটিক। গত দেড় মাসে অফিসের কাজে বা নিজের ব্যক্তিগত পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার গ্রোথে যে পরিমাণ প্রোডাক্টিভ ছিলাম অন্য সময় হয়ত এতটা ছিলাম না। আগে খাওয়ার পর ২ ঘন্টা রেস্ট নিতে ইচ্ছা করত। মনে হত বিরাট পরিশ্রমের কাজ হল। দুপুরে ঝিমানি আসত। আগের অফিসে আমি দুপুরের পর নিয়মিত ২০ মিনিট ঘুমাতাম। কিন্তু এখন খাওয়ার পর মনেই হয় না কিছু হলো। দেহ পরিমিত পুষ্টি পাচ্ছে। প্রয়োজনের বেশি খেয়ে পেট ঢোল করে পড়ে থাকছি না। আগের চেয়ে ডেইলি রুটিনটা আরো বেশি সুশৃঙ্খল হয়েছে। ছোট বেলার সেই আর্লি টু বেড, আর্লি টু রাইজের দিনগুলোতে ফিরে যেতে পেরেছি। সকালে না ঘুমানোর জন্য বেশ খানিকটা সময় পাওয়া যাচ্ছে পড়াশোনা আর সেলফ ডেভেলপমেন্টের জন্য। গ্যাস্ট্রিক আগেও ছিল না, আগামীতে ইনশাআল্লাহ কখনো হবেও না। কারণ বাইরের বিষাক্ত ভাজা-পোড়া, ফাস্টফুড, কোল্ডড্রিংক্স, দুধ-চা, দুধ-চিনি দেয়া কফি ইত্যাদি সব খাবার বাদ দিয়েছি। ব্যাগে এখন একটা ছোট পটে বাদাম রাখি। ক্ষুধা লাগলে বাদাম খাই। জীবন মরণ সমস্যা ছাড়া একেবারে বাধ্য না হলে বাইরের খাবার ইনশাআল্লাহ খাব না।
ভাত খেলে কি আবার ওজন বেড়ে যাবে?
আমি ফ্যাট বার্নিংয়ের এই প্রসেস আপাতত থামিয়ে দিয়েছি। কারণ আমার টার্গের ছিল ৬২-৬৩ কেজিতে এনে ওজন স্থির রাখা। ৪৮ দিন পর ২০ মার্চ ২০২০ তারিখে আমি ভাত খেলাম। ফেসবুকে অনেকেই বললেন বা আলোচনাতেও অনেকে বলেন ওজন এত দ্রুত কমানো ঠিক না। দ্রুত কমলে দ্রুত বেড়ে যাবে। ১ মাসে ৫ কেজি না কমিয়ে ৫ মাসে ৫ কেজি কমালে সেটা স্থায়ী হবে। ভাত খাওয়া শুরু করলে আবার ওজন বাড়বে। তাদের কথা কিছু সঠিক আর কিছুর ব্যাপারে আমার জানা নাই। আমি যদি ১১ কেজি ওজন কমিয়ে সামনের এক মাস আবার এক গামলা করে ভাত বা রুটি, সপ্তাহে ১ টা ২ টা করে বার্গার। ২ সপ্তাহে ১ বার অন্তত কাচ্চি। সপ্তাহে ১ দিন অন্তত সিঙ্গারা-সমুচা খাই। তিন বেলা নিয়ম করে খাই। কোল্ড ড্রিংক্স খাই, এক্সারসাইজ না করি। তাহলে তো নিঃসন্দেহে আগের চেয়ে অনেক বেশি ওজন আমি গেইন করতে পারি সামনের ২ মাসে। এটা আলাদা করে বলার কী হলো?
যারা ওজন কমানোর প্রকৃয়া শুরু করেন তারা কেন আবার আগের লাইফ স্টাইলে যাবেন? আমি এখন দুই বেলা খাবার খাই। দুই বেলাতেই আমি ভাত খাই। কিন্তু কোনো বেলাতেই পেটের অর্ধেকের বেশি খাবার খাই না। আল্লাহর রাসূলের (সা) স্পষ্ট নিষেধ পেট পূর্ণ করে খাবার খেতে। ক্ষুধা না লাগলে আমি খাই না। আমরা যারা কায়িক পরিশ্রম করি না, ডেস্ক জব করি। তাদের নিয়ম করে ৩ বেলা পেট ভরে কেন খেতে হয়? একমাত্র কারণ অভ্যাস। দ্বিতীয় কারণ legacy. বাপ-দাদাদের থেকে দেখে আসছি তারা তিন বেলা এত্তগুলা করে ভাত খেতেন। আমরা খাওয়ার শিক্ষাটা নিয়েছি। কিন্তু খাওয়ার পর ঘাম ঝড়িয়ে কী পরিশ্রমটাই না তারা করতেন! সেই শিক্ষাটা নেই নাই। এজন্য আমি বাসায় ওজন মাপার মেশিন কিনব ইনশাআল্লাহ। নিয়মিত মনিটর করব ওজন বাড়ার মত হচ্ছে কিনা। বাজে খাবারগুলো চিরতরে বাদ দিব। পোলাও বিরানী খেতে ইচ্ছা করলে বাসায় খাঁটি ঘি দিয়ে রান্না করে খাব। ফাস্টফুড বা প্রসেস ফুড খাব না। সপ্তাহের সোম আর বৃহস্পতিবার রোজা রাখব ইনশাআল্লাহ বাকি জীবন। এই রোজা রাখার সময় সাহরিতে পানি আর খেজুর ছাড়া কিছু খাব না পারত পক্ষে। ইফতারে কোনো ভাজাপোড়া না। সবজি-সালাদ অল্প একটু ভাত। সকালে রেগুলার দৌঁড়াব ইনশাআল্লাহ। আগামী বছর হাফ ম্যারাথনে দৌঁড়ানোর ইচ্ছা আছে। সাঁতার জানি না। সাঁতারের খোঁজ খবর করছি। এটা শিখব ইনশাআল্লাহ। এসবের পরেও ওজন বাড়ার দিকে মনে হলে সপ্তাহে ২ টার জায়গায় ৪টা রোজা রাখব। ইনশাআল্লাহ তাতে ২-৩ সপ্তাহে আবার ওজন কমে আসবে।
আমার স্বাভাবিক ওজনের রেঞ্জ হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬৬ এর মধ্যে। আমি ৬২-৬৩ কেজির মধ্যে ওজন ধরে রাখার ইচ্ছা করি। খাবার কম খাওয়ার মধ্যে যেসব কল্যান আছে সেগুলো অর্জন করার ইচ্ছা করি। আমাদের দেশের মা-খালাদের রান্নার প্রধান উদ্দেশ্য থাকে কিভাবে মজাদার রান্না করে ভাত কিছু বেশি খাওয়ানো যায়। তারা মজা হওয়ার দিকে নজর দেন। যতটা দেন না পুষ্টির দিকে। টার্গেটই থাকে ভাত বেশি খাওয়ানো। মনে হয় যেন ১ প্লেট বেশি ভাত খেলে সেটা বিরাট সওয়াবের কাজ হল। ছেলেমেয়েদেরকে ১ চামচ ভাত বেশি খাওয়াতে পারলে সেটাকে অনেক মা মনে করেন বিরাট অ্যাচিভমেন্ট! পুষ্টি চাহিদা মেটা আমাদের সমাজের উদ্দেশ্য না। উদ্দেশ্য হচ্ছে পেট ভরা। তাই হাবিজাবি আবর্জনা যা দিয়েই হোক, পেট ভরাতে পারলেই আমরা খুশি। খাবারে আমাদের নানা পদ থাকে। কয়েক পদের তরকারি আর চাটনি থাকে। যেন রুচি বাড়ে, যেন আরেকটু বেশি খেতে পারি। আল্লাহর রাসূল (সা) খাবারের এই রুচি বাড়ানোর উপাদানগুলোকে খুব অপছন্দ করতেন। অসংখ্য হাদীস পাওয়া যায় কম খাওয়ার ব্যাপারে, রোজা রাখার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়ে। আমরা সেগুলো জানিই না! জানলেও আমরা তা মানব কেন? আমরা তো মানব ফিরিঙ্গিদের অঙ্গুলি নির্দেশনা। দাদাবাবুরা যেদিকে দৌঁড়াতে বলবেন সেদিকে দৌঁড়াব।
যাই হোক, আল্লাহ আমাকে এই মত ও পথের উপর অবিচল রাখুন। দেহে চর্বি বাড়ার মাধ্যমে অসংখ্য রোগের উৎপত্তি ঘটে। অন্য সকল রোগ এবং ওজন বৃদ্ধিজনিত রোগ থেকে আল্লাহ আমাদের সবাইকে মুক্ত রাখুন। শরীরে আল্লাহ যেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়েছেন সেগুলো ধরে রাখার ও বৃদ্ধি করার তাওফিক দান করুন। ডাক্তার জাহাঙ্গীর কবির জনসচেতনতার জন্য তার মূল্যবান সময়, মেধা ও শ্রম দিচ্ছেন। আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। যত মানুষ ওজন বৃদ্ধিজনিত সমস্যায় ভুগছেন তাদের সকলের সমস্যাকে আল্লাহ মিটিয়ে দিন। আমীন।