Post updated on 21st February, 2020 at 09:39 am
পল বোমার। ১৯১৪ সাল থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত চলা ইতিহাসের ভয়ংকরতম প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এক সদ্য কৈশর পেরোনো যোদ্ধা। স্কুলের একজন শিক্ষকের উপর্যুপরি উৎসাহে তারা ৯ জন একত্রে নাম লেখায় যুদ্ধে যাবার জন্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এক পক্ষে ছিল উসমানীয় সাম্রাজ্য, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, জার্মানি ও বুলগেরিয়া। অপরপক্ষে ছিল সার্বিয়া, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি, রুমানিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গল্পের পল বোমার জার্মানের অধিবাসী। জার্মানির পক্ষে সে ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয় ইংরেজ ও ফরাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে। সদ্য গজানো গোঁফের রেখা দেখা যাচ্ছে যার চেহারায়, সেই পলই নিজেকে আবিষ্কার করে কখনো ট্রেঞ্চের ভিতর। কখনো কামানের গোলায় মাটিতে হওয়া বিরাট গর্তের মাঝে আত্মগোপন করা অবস্থায়। কখনো বা কোনো গোরস্থানের ভাঙা কবরের কফিনের নিচে। গায়ের উপরে ঢাল হিসাবে যখন সে ব্যবহার করছে অর্ধ গলিত পচা মরা মানুষ। যেন গোলার স্প্লিন্টার তার গায়ে না লাগতে পারে। উপন্যাসের পুরো গল্পটি আমরা জানতে পারি পল বোমারের জবানীতেই।
বইটির লেখক এরিখ মারিয়া রেমার্ক একজন জার্মান ঔপন্যাসিক। ১৯১৭ সালে ১৮ বছর বয়সে তিনি যোগ দেন জার্মান সেনাবাহিনীতে। ধারণা করা হয় এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র পল বোমারের গল্পটা আসলে রেমার্কের নিজের জীবনের গল্প। ১৯১৮ সালে যুদ্ধ শেষ হলে তিনি ফিরে এসে শিক্ষকতা শুরু করেন। এছাড়াও তিনি ব্যবসায়, সাংবাদিকতা, লাইব্রেরিয়ান সহ সম্পাদনার কাজও করেন। ১৯২৮ সালে জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হয় তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট। এই উপন্যাসটির মাধ্যমে তিনি সাহিত্যের নতুন এক জনরা বা রীতি তৈরি করেন। প্রথমে এটি জার্মানী পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও পরের বছর ১৯২৯ সালে এটি বই আকারে বাজারে আসে এবং ইন্টারন্যাশনাল বেস্ট সেলার বই হিসাবে নিজের জায়গা করে নেয়। এই বইয়ের কাহিনীর উপর ভিত্তি করে একই নামে ১৯৩০ ও ১৯৭৯ সালে দুইটি মুভিও নির্মিত হয়। ১৯৩৩ সালে অ্যাডলফ হিটলার জার্মানির রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পর লেখকের সকল লেখাকে পাবলিকলি “unpatriotic” বা “দেশাত্ববোধশূন্য” বলে ঘোষণা করা হয় ও জার্মানিতে তার সকল বই নিষিদ্ধ করা হয়। এমন কি ১৯৩৯ সালে তার নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। এরপর তিনি সুইজারল্যান্ডে পারি জমান। ১৯৭০ সালে ৭২ বছর বয়সী এই কালজয়ী লেখক সুইজারল্যান্ডেই মৃত্যুবরণ করেন।
পল বোমারের ঠোঁট দিয়ে হয়ত লেখক বলিয়ে নিয়েছিলেন তারই আঠার বছর বয়সের অভিজ্ঞতার কথা। একটা যুদ্ধের সাথে জড়িত কোটি কোটি মানুষের পরিবার। সৈন্যরা যখন ক্যাম্প থেকে ফ্রন্টে যাচ্ছে তখন তাদের কেউই জানে না আর কখনো ক্যাম্পে ফিরে আসবে কিনা। ক্যাম্পে থাকা সৈনিকদের সাথে বিদায় নেয়াটা কারো কারো জন্য হয় শেষ বিদায়। ফ্রন্টে যাবার পথে যেমন সুন্দর ফসলের মাঠ, শান্তির পায়রা দেখা যায়। একই সাথে দেখা যায় ভারী গোলার আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাওয়া অসংখ্য সৈন্যদের দেহাবশেষ। যার কিছু ঝুলছে গাছের ডালে, কিছু লেপ্টে আছে গাছের গুড়িতে, কিছু বা লেগে যাচ্ছে হাঁটার সময় বুটের সাথে। ফ্রন্টে যাওয়ার পথে তারা দেখতে পায় সারি সারি নতুন আনানো কফিন দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে ওদেরই কারো কারো জন্য। এদের মধ্যে অনেককেই হয়ত ফিরতে হবে ঐ কফিনের বাসিন্দা হয়ে। যুদ্ধের শারীরিক ক্ষয় ক্ষতির সাথে মানসিক ক্ষয় ক্ষতির যে বিস্তৃতি, সে বিষয়ে একটা মর্মস্পর্শী উক্তি উল্লেখ না করলেই নয়ঃ
যুদ্ধের প্রথম বোমাটা পড়ে ঠিক বুকের মাঝখানে…
সৈনিক মানেই যেন সীনা টান করে দাঁড়ানো চকচকে বুট পায়ে দেয়া চৌকষ যুবক। কিন্তু আমরা পলের রেজিমেন্টে দেখতে পাই এক জোড়া ভাল বুটের জন্য সৈনিকদের কতটা আকুতি। পলদের গ্যাংয়ের কেমারিখ আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। তার পা কাটা পড়েছে। একই গ্যাংয়ের মুলার আগে ভাগে বুক দিয়ে রেখেছে যে কেমারিখ মারা গেলে বুট জোড়া সে নিবে। মুলার মারা যাবার পর বুট জোড়া পায় পল বোমার। সে আবার আগেই জাদেনকে এ বুটের ওয়ারিশ বানিয়ে যায় যদি সে মরে যায়। একদিকে যেমন আছে সতীর্থ হারানোর কষ্ট, মুদ্রার অপর পিঠে আছে এক জোড়া ভাল বুট পাওয়ার আনন্দ। হয়ত ফ্রন্টে যুদ্ধের সময় এক জোড়া ভাল বুট বাঁচিয়ে দিতে পারে তার পা এমন কি তার জীবন। ফ্রন্ট থেকে ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি নিয়ে ফিরে আসা রেজিমেন্টের সৈন্যদের বুক ভেঙে যাচ্ছে তাদের সঙ্গীদের হারানোর কষ্টে। একই সাথে ২-১ বেলা তাদের ভাগের খাবারটা খেতে পাবার আনন্দটাও তাদের নেহাত কম নয়।
ফ্রন্টে বেঁচে থাকার জন্য একটাই উপায়, “মারো”। যেন এই স্কুলগামী কিশোরদের শরীরে অশরীরী শক্তিমত্তা। গায়ে বিন্দু শক্তি না থাকলেও তারা প্রাণের ভয়ে ছুটতে পারে। গর্তে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় পা ফসকে কোনো শত্রু সেনা গর্তে পড়লে মুহূর্তে তার গলা ছুরি দিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতে পারে। আবার ক্যাম্পে ফিরে এসে বিরোধী যুদ্ধবন্দীদের অসহায়ত্বও তাদেরকে কষ্ট দেয়। রাতের অন্ধকারে হয়ত বাড়িয়ে দেয় কয়েকটি সিগারেট। বা বাড়ি থেকে মায়ের বানিয়ে পাঠানো দুই টুকরা কেক।
কেন যুদ্ধ হয়? এক দেশ আরেক দেশকে দখল করতে চাইলে যুদ্ধ হয়। তাহলে কি এক দেশের পাহাড় আরেক দেশের পাহাড়কে সরে যেতে বলে? এক দেশের নদী কি আরেক দেশের নদীকে ভেসে যেতে বলে অন্য দিকে? তাহলে দেশ কিভাবে আরেক দেশকে অপমান করে বা দখল করে? এই আলোচনা চলতে থাকে পল, কেমারিখ, কাট, ক্রপ, জাদেন সহ সকল সৈনিকদের আসরে। তারা ভেবে পায় না কোথায় কোন টেবিলে কোন কাগজে কেউ সই করল। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মতই কিছু রক্তে মাংসে গড়া মানুষ আমাদের শত্রু হয়ে গেল। তাদের উপর আমাদের ঝাপিয়ে পড়তে হবে। তাদেরকে মারতে হবে। নইলে আমাদেরকে মরতে হবে। কী অদ্ভুত না? হিসাব মেলে না পলদের। তাদের ভাবনার বিরাট একটা অংশে জমা হয় শুধু হতাশা। তারা তো স্কুল ছেড়ে চলে এসেছে যুদ্ধে। গিয়ে কী করবে? ওদের শৈশব-কৈশর কে ফিরিয়ে দিবে? ওদের যখন গল্পের বই আর রঙিন কমিক্স নিয়ে আলোচনা করার কথা তখন তারা ছক কষছে কিভাবে কোনো মতে গর্ত থেকে বের হয়ে ট্রেঞ্চে ফেরা যায়। ওরা যুদ্ধের যেই ভয়াবহ স্মৃতি নিয়ে বেড়াচ্ছে তার থেকে মুক্তি কি কখনো পাবে? তারা যেন যুদ্ধের রক্ত, মাংস, বারুদের গন্ধে আর এক রাশ ঘৃণ্য স্মৃতি নিয়ে ১৯ বছর বয়সী বৃদ্ধে পরিণত হয়েছে।
অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট বইটির কয়েকটি বাংলা অনুবাদ বাজারে পাওয়া যায়। আমি প্রজাপতি প্রকাশনীর থেকে প্রকাশিত জাহিদ হাসানের অনুবাদটা পড়েছি। জানা মতে এটাই সবচেয়ে ভাল অনুবাদ। বারোটি অধ্যায়ের মাধ্যমে বইটিকে ভাগ করা হয়েছে। বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৪০।
যারা থ্রিলার বা war movie/novel পছন্দ করেন তাদের জন্য এটা মাস্ট রিড একটা বই। যুদ্ধের প্রতিটা মুহূ্র্তকে ধরে আনা হয়েছে কালো অক্ষরের জালে। সৈনিকদের দুঃখ, কষ্ট, হতাশার গল্পে হারিয়ে যাবেন নিশ্চিত। মনের অজান্তেই সেগুলো একে একে মিলে যাবে নিজের জীবনের সাথে। আমরা সম্মুখ সমরে অংশ নিই না ঠিক, কিন্তু আমাদের জীবনও কি যুদ্ধ ছাড়া আর কিছু? একটা এ প্লাস পাওয়ার জন্য যুদ্ধ। ভাল ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার জন্য যুদ্ধ। ভাল চাকরির জন্য যুদ্ধ। পছন্দের মানুষকে হারিয়ে ফেলার যুদ্ধ। কোনটার চেয়ে কোনটা ছোট? জীবনের প্রতি পদে পদে থাকা যুদ্ধের কালশিটে দাগ আর ক্ষত আমরাও ভুলে থাকতে চাই পল বোমারদের মত। আমরাও প্রতিনিয়ত চাই জীবনের কষ্টের আর সবচেয়ে ভয়াবহ সময়গুলোকে সমুদ্রের পানির এক ঝাপটায় বালির উপর লেখাগুলো মুছে ফেলার মত করে মুছে ফেলতে। চাই দুঃখগুলোর স্মৃতিগুলো ভুলে এক পশলা বৃষ্টির মত কয়েক ফোঁটা সুখ পেতে। চাইলেই কি জীবনটা সুন্দর আর সুখের করা যায়? সবার জীবনই?