Post updated on 1st September, 2021 at 06:51 am
তখন সম্ভবত ক্লাস ফাইভে পড়ি। বাসার পাশের মুহাম্মদাবাদ ইসলামিয়া আলিম মাদরাসার ছাত্র ছিলাম। এর আগে হাফেজী পড়ার সুবাদে আল্লাহর রহমতে ১২-১৩ বছর বয়স থেকেই কুরআন মাজীদ শুদ্ধ করে পড়তে পারতাম। তাই চর্চা ধরে রাখার জন্য বাচ্চাদেরকে কুরআন পড়া শেখাতাম। আমার প্রথম স্টুডেন্ট ছিলেন ক্লাস টেনে পড়া এক বড় আপু! কয়েকজনকে পড়ানোর পর কিছু সিসটেম ফলো করা শুরু করলাম শেখানোর কাজটা সহজ করবার জন্য। আগে সবার খাতায় লিখে দিতাম আরবি পড়ার কিছু নিয়মরীতি বা গ্রামার। পরে ঘেটেঘুটে একটা শিট বানালাম। যেটা সবাইকে ফটোকপি করে দিতাম।
ভালই পড়াচ্ছিলাম। ক্লাস ফাইভে থাকতেই এক রকম ইনকাম করা শুরু হয়ে যায়। তবে বেশির ভাগ সময় বেতনের টাকা আম্মুকেই দিয়ে দিতাম। বা নিজের পছন্দের বই-পুস্তক কেনার জন্য ব্যয় করতাম। এমন কি ক্লাস সেভেনে থাকতে প্রথম মোবাইল কিনি নিজের টাকায়। হাত খরচের জন্য তখন থেকেই বাসায় চাইতে হত না।
কুরআন পড়ানোর সাথে আরেকটা কাজ করতাম। ঠিকঠাক মত নামাজ পড়তে শেখানো ও নামাজের দোয়াগুলো শেখানো। সপ্তাহে একদিন নামাজের লেসনগুলো দিতাম। তো এক স্টুডেন্টের মা একদিন বললেন “ছাত্র তো নামাজ পড়তে পারে, কিন্তু নিয়ত তো পারে না! ওকে নিয়তগুলো শিখায় দিও!” আমি বললাম “আন্টি! নিয়ত তো আমি নিজেও পারি না! আমাদের হুজুররা কখনো ‘আরবি নিয়ত’ মুখস্ত করার ব্যাপারে প্রেশার দেন নাই। কোন কাজের নিয়ত অর্থ হচ্ছে সেই কাজটা করার ইচ্ছা করা। নামাজ বা রোজার ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট বাক্য পড়ে নিয়ত করা জরুরি না!”
আর যায় কোথায়!!!
“এইটুকু পিচ্চি! আমারে আসছে জ্ঞান দিতে! আমরা আর ধর্ম-কর্ম জানি না? দুই লাইন সিপারা পইড়া একেবারে বিদ্যার জাহাজ হইয়া গেছে!” ইত্যাদি বাক্যবানে একরকম জর্জরিত হলাম। পারলে আমার মত ‘ভ্রান্ত’ লোকের কাছে কুরআন পড়ানোই বাদ দিয়ে দেন!
App of Ramadan নামের আমাদের একটা Android App আছে। সেখানে সারা বছরের সকল জেলার নামাজের সময়সূচী ও সাহরি ইফতারের সময়সূচী দেখা যায়। সেখানে একজন 1 star দিয়ে রিভিউ দিলেন যে “apnadar app a rojar niyot a vol aca”। তিনি বুঝাতে চেয়েছিলেন আমাদের এপে রোজা রাখার নিয়ত হিসেবে যেই দুয়ার উল্লেখ আছে সেটা ভুল।
যাই হোক, গল্প বলার পেছনের কারণ হচ্ছে সমাজের অবস্থাটা পরিস্কার করা। আসলেও কি “নাওয়াইতুয়ান…” বলে নামাজ বা রোজার নিয়ত করা জরুরি?
ধরেন আপনি কেবল আজকে মুসলিম হলেন। আরবি কিসসু জানেন না। আপনাকে আমি ভোর রাতে ডাকলাম। কিছু খাইয়ে বললাম আমার সাথে বলেন “নাওয়াইতুয়ান আসুমা গাদাম্মিন…” মানে রোজার নিয়ত বলে যেটা প্রচলিত সেই বাক্যগুলো আপনাকে পড়তে বললাম। সারাদিন আপনাকে চোখে চোখে রাখলাম। এমন কি পানিও খেতে দিলাম না। এদিকে আপনি রোজা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। ইফতারের সময় আপনাকে খেতে দিলাম। আপনার কি মনে হয় আপনার রোজা হবে? নিয়ত করার অর্থ ছিল নিজে নিজে ইচ্ছা করা বা সংকল্প করা রোজা রাখার ব্যাপারে। আপনি আরবিতে দোয়া পড়েছেন। কি পড়েছেন নিজেও জানেন না। কিন্তু নিজের মনে সংকল্প বা ইচ্ছা করেন নাই রোজা রাখার ব্যাপারে। তাই আপনার কিন্তু ঐ দিন রোজা হিসেবে গণ্য হবার কোন কারণ নাই। তাই রোজার নিয়তের ব্যাপারে আলেমগণ বলেন “সেহরি খেতে ওঠা মানেই রোজার নিয়ত”। কারণ সেহরিতে আপনি ‘ক্ষুধা লেগেছে তাই উঠে একটু খাই’ এই চিন্তা করেন না। বরং চিন্তা করেন রোজা রাখব তাই উঠে সেহরি খাই। এটাই তো আপনার রোজা রাখার ব্যাপারে সংকল্প। রোজা রাখার জন্য সেহরি খাওয়ার সময় যদি আপনার মনে রোজা রাখার ইচ্ছা থাকে সেটিই আপনার নিয়ত বলে গণ্য হবে। কিন্তু সেহরি খাচ্ছেন কিন্তু রোজা রাখার ইচ্ছা নাই বা ইচ্ছা করলেন না সারাদিন somehow না খেয়ে থাকলেন তাহলেও কিন্তু সেটি রোজা হবে না। (কিতাবুল ফিকহ)
একই রকম ভাবে নামাজ পড়ার আগে ওযু করলেন। এই ওযুই কিন্তু নামাজের নিয়ত। নামাজ পড়বেন বলেই ওযু করা। এক ওযু দিয়ে অনেক নামাজই পড়া যায়। যখন মাগরিবের আগে ওযু করে জামাতে শামীল হলেন তার মানে কিন্তু ফরজ নামাজই আদায় করলেন। এরপর দুই রাকাত নামাজ পড়লেন সেটা কিন্তু সুন্নাত নামাজ হিসেবেই পড়লেন। মুখে উচ্চারণ করেন বা না করেন পুরো বিষয়টা কিন্তু আপনার ব্রেনে কাজ করে। ৩ রাকাত নামাজ শেষে যখন দাঁড়িয়ে আরো ২ রাকাত পড়েন সেটা কেন পড়ছেন কী নামাজ সেটা কিন্তু আপনার মনে ঠিকই আছে। পুরোটাই আপনার মনের ব্যাপার। আল্লাহ আপনার মনের খবর তো জানেনই!
আরবিতে যেই নিয়তগুলো প্রচলিত আছে তার কোনটাই কুরআন বা হাদীস থেকে আসে নাই। এটা শুধুমাত্র আরবি ভাষায় বলা কয়েকটা কথা। যেটা আপনি নিজের মনে নামাজ বা রোজার আগে অলরেডি চিন্তা করে ফেলেছেন। নামাজের আরবি নিয়তে এটাই বলা থাকে যে “আমি ক্বেবলামুখি হয়ে এই ঈমামের পিছনে মাগরিবের তিন রাকাত নামায় আদায় করছি”। তাই আপনি যদি আরবিতে নিয়ত করেন সমস্যা নাই, কিন্তু ঐ নিয়তের অর্থ সম্পর্কে জানা থাকা দরকার। মুখে উচ্চারণ করলাম রোজার নিয়ত কিন্তু আমার রোজা রাখার আসলে কোন প্ল্যান নাই তাহলে কিন্তু রোজা শুদ্ধ হবে না।
যেহেতু নিয়ত অর্থ সংকল্প করা। তো কেউ মনে মনেও সংকল্প করতে পারেন। উচ্চারণ করেও করতে পারেন। একেকজন আলেম বা ঈমামের আরবি নিয়ত বা সংকল্পের ভাষাও ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তাই গুগলে niyat of sehri লিখে সার্চ করলে যেই দোয়াটা পাবেন দেখবেন সেটার সাথে হয়ত আপনারটা মিলছে না। ইফতারের ক্ষেত্রেও অনেক ধরণের দুয়া পাবেন। এর কারণ একটাই। কোন সহীহ হাদীসে নিয়তের বাক্যগুলোর উল্লেখ নাই। যদি থাকত তাহলে সবার নিয়ত একই রকম হত। এই কথাটা আমাদের এপের ইউজারকে বুঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। মনে হয় না তিনি বুঝেছেন। কারণ আমরা “বাপ-দাদারা সারা জীবন কইরা আসছে” এই নীতিতে বিশ্বাসী! সুস্পষ্ট প্রমাণ সামনে আসার পরেও আমরা মুরুব্বিদের রেফারেন্স টানি। যাদের অনেকেই ছিলেন না জেনে শিরক আর বিদআতে নিমজ্জিত।
কিছুদিন আগে একটা লেখায় পড়লাম যে আরবিতে নিয়ত করলে সওয়াব হবে বা এটাকে সুন্নাহ মনে করা বিদআতের পর্যায়ে পড়ে যাবে। কেননা ইসলামী শরীয়াহ দ্বারা নিয়তের এই বাক্যগুলো প্রমাণিত না। যেই জিনিস ইসলাম বা দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত না সেটাকে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত মনে করা বা পালন করার নামই বিদআত। কেউ যদি কুরআনের ভাষা আরবি, রাসূলের (সাঃ) ভাষা আরবি সেই ভালবাসার জায়গা থেকে অর্থ বুঝে নিয়তের বাক্যগুলো পড়েন তাহলে হয়ত সমস্যা নাই। সমস্যা হবে তখনই যখন আপনি মনে করবেন “আরবিতে নিয়ত করলে বেশি সওয়াব বা আরবিতে নিয়ত করাই উত্তম”। তবে আরবি-বাংলা-ইংরেজি যেই ভাষাতেই নিয়তটা মুখে উচ্চারণ করলেন বা বিড়বিড় করলেন সেটা একটা অহেতুক রিডানডেন্ট কাজ হলো। আপনার মনে অলরেডি আছে আপনি অমুক নামাজ পড়বেন, কিন্তু আবার মুখে বিড়বিড় করলেন যে “আমি অমুক নামাজ পড়িতেছি”। অনেকটা এরকম যে অফিসে যাওয়ার জন্য বের হয়েছেন এবং মুখে উচ্চারণ করলেন “আমি অফিসে যাইতেছি”।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে বিদআত ও মনগড়া রীতিতে ইসলাম পালন করা থেকে বিরত রাখুন। মুরুব্বি বা ‘বাপ-দাদাদের’ দেখানো পথ অনুসরণ করে ইসলাম পালন নয়। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর ও তাঁর রাসূলের (সাঃ) দেখানো পথ অনুসরণের তাওফিক দান করুন। আমীন।
[লেখায় তথ্যগত বা যে কোন ধরণের ভুল ধরা পড়লে অনুগ্রহ করে জানাবেন। কৃতজ্ঞ থাকব আপনার প্রতি। ধন্যবাদ।]
Thanks… onek kichu janlam…
You are most welcome 🙂
100% right
আমিও আপনার মতই একটারও নিয়ত আরবিতে জানি না ।
অসাধারণ লেখনি.. আমি নিজেও নামাজের আরবী সবগুলো নিয়ত জানি এবং নিয়ত নিয়ে নিজের ভ্রান্তধারণা থেকে এতদিন এই এটা করে আসছি। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমা করবেন আমাকে 🙂
Vaiya jazhakallah🙂,,,onek help hoi apnader post pore,,amar ekta prosno,,,, meyeder r celeder namaj ki asolei ek???!!!kono group a dekhi cele meyer namaj ek ei niye post sathe reference abar,,,, kothao kothao meyeder namaj e betikrom ace bole sekhaneo bivinno reference dewa,,,,ekhon konta manbo,,,🙂
উভয়টিই জায়েজ আছে এবং উভয়টিই সুন্নাহ সম্মত। দুই পক্ষেই হাদীসের দলিল আছে। তাই যার যেটা সুবিধা বা যে যেই মাজহাব বা আলেমের মতের অনুসরণ করে এটা সেই আলেম বা সেই ইমামের মত ফলো করা যেতে পারে। এজন্য দলাদলি ও কাদা ছুড়াছুড়ি করা যাবে না। একটা মতের উপর আমল করলে অন্যটাকে খারাপ বলা বা বাতিল বলা যাবে না। কারণ দুইটাই হাদীস থেকে এসেছে। কোনোটাকে খারাপ বা বাতিল বললে পক্ষান্তরে হাদীসকেই বাতিল বলা হয়। নিচের লেকচারগুলো দেখতে পারেন।
1. https://youtu.be/-w8q0pewgkA
2. https://youtu.be/eUkyXsA-3Gs
3. https://youtu.be/aiesnlf9TeQ
আমিও কোন নামাযের নিয়ত আরবিতে জানি না।
কিন্তু সব সময় মনে মনে সংকল্প করি।
আমি আজ পর্যন্ত কোনো নিয়তই মুখস্থ করিনি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সংকল্প করেই আদায় করছি ইনশাআল্লাহ।
ফতোয়া দিতে দেরি করেন না আরবি নিয়ত শিখলে বা জানা থাকলে আপনার অসুবিধা কোথায়। আপনার কোরান হাদিসের সুস্পষ্ট জ্ঞান না থাকলে সে বিষয়ে কথা বলার অধিকার আপনার নেই। রেফারেন্স দিলেন আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীরের। শিরক বেদআত সমপর্কে আমাদের যথেষ্ট ধারণা আছে আপনার থেকে শেখা লাগবে না।
বায়বীয় কথাবার্তা না বলে টু দি পয়েন্টে পোস্টের ভুলগুলো ধরিয়ে দিলে ভাল হত।
ধন্যবাদ আপনার “ব্যক্তিগত” মন্তব্যের জন্য।
মাশা আল্লাহ,অনেক কিছু শিখতে পারলাম।,❤️💚