Post updated on 9th June, 2017 at 10:09 pm
“ভাই, ছেলেকে কচু শাক খাওয়ান না? একমাস টানা ডেইলি কচুশাক খাওয়ান। এরপর যদি ওর চোখ ভাল না হয় তাইলে আমারে কইয়েন!”
আব্বুর সাথে কোথাও বেড়াতে গেলেই এরকম প্রাকৃতিক ডাক্তারদের মুখোমুখি হতে হত আব্বুকে। ৭ বছর বয়সে চশমা পড়া শুরু করি। সেই সময়ে ঐ বয়সী ছেলেপুলের চশমা পড়া গুরুতর ‘পাপ‘ (!) বিবেচনা করা হত।
আবাল বৃদ্ধ বণিতারা ধরেই জিজ্ঞেস করত “নিশ্চয়ই শাক সবজি খাও না?” আমি বলতাম প্রতিদিনই শাক সবজি খাই। পরের প্রশ্ন “নিশ্চয়ই ছোট মাছ খাও না?” আমি বলতাম কাচকি আর মলা মাছ আমার খুব পছন্দের! তেনারা হারার পাত্র নন, নেক্সট প্রশ্ন “তাই বুঝছি, নিশ্চয়ই সারাদিন টিভি দেখ?” উত্তর “আমাদের বাসায় টিভি নাই!” 😀
যাই হোক, লোকজনের এই ‘কচুশাক‘ এর বয়ানের কারণেই হয়ত এই জিনিস খেতে চাইতাম না। দুই চৌক্ষের বিষ ছিল এই বস্তু। একদিন সব উলটে গেল!!!
কোন আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে সম্ভবত কলকাতার “গুরু দক্ষিণা” সিনেমাটা দেখছিলাম। সেইরকম আবেগী সিনেমা। কান্নাকাটির উপক্রম হয়েছিল কিনা মনে নাই। সেখানে যিনি গানের গুরু থাকেন তিনি ‘কচুশাক‘ খেতে খুব পছন্দ করতেন। মুভির মধ্যে এমন ভাবে তার কচুশাক খাওয়ানোর দৃশ্যগুলো দেখানো হয়েছে যে আমার কাছে মনে হতে লাগল ‘কচুশাক না খাইলে তো জীবন বৃথা!’
তাকে তার নাতনী বা কেউ একজন লুকিয়ে কচুশাক দিয়ে যেত ছোট বাটিতে করে। তিনি চামচ দিয়ে খুব তৃপ্তি সহকারে খেতেন। (ইশ!!! জিহ্বায় পানি চলে আসল ইফতারের এই আগ মুহুর্তে! 😛 )
সেই কচুশাক খাওয়ার দৃশ্যগুলো মনের মধে গেঁথে গেল। বাসায় এসে আমিও কচুশাক খাওয়া শুরু করলাম। সবাই ভাত দিয়ে খায়, আমি বাটিতে করে চামচ দিয়ে খাই। আর মুখের এক্সপ্রেশন করি ঐ মুভির লোকটার মত… তিনি তৃপ্তিতে এক্সপ্রেশন দিতেন, আমি দেই আবেগে… ^_^ 😀
“এরপর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয় নি…”
ইয়ে মানে চশমা পড়া বাদ দিতে হয়েছে ব্যাপারটা তা না। মানে হচ্ছে এরপর থেকে কচুশাক ঠিকঠাক মতই খাই। যেই ইগনোর করার ব্যাপারটা ছিল সেটা আর নাই। মুভির কয়েকটা সীন দেখেই এই ভাল জিনিসটা খেতে আগ্রহ তৈরি হল।
…
এইবার আসি একটু অফটপিকে।
মুভির মধ্যে যে শুধু ‘পুষ্টিকর কচুশাক‘ খাওয়ানো দেখানো হয় ব্যাপারটা কিন্তু তা না। বিড়ি–সিগারেট, মদ–গাঁজা, হাবিজাবি গু–গোবর খাওয়ানোর বিষয়গুলো আরো বেশি দেখানো হয়।
এত দুর্দান্ত ভাবে নায়ককে বিড়ি খেতে দেখানো হয় যে আমার মত গোবেচারা পাবলিকেরই মনে হয় “মোড়ের দোকান থিকা কিন্যা আয়েশ কৈরা দেই একটা টান…”। পরে আর সাহসে কুলায় না… 😛
খোরেরা হয়ত আমার গুষ্ঠি উদ্ধার করে ছাড়বে এই পোস্টের পরে। “আমরা দেশের এত পার্সেট ভ্যাট দেই। আমার ভ্যাটের পয়সায় রাস্তা বানানো হয়। তুই হালা সেই রাস্তায় সাইকেল চালাস, আবার আমাগোরে গালমন্দ করস!!!” একদল ইসলামপন্থী খোরেরা হাজির হবে “পারলে প্রমাণ কৈরা দ্যাখা যে বিড়ি খাওয়া ইসলামে নিষেধ! দেখি তোর দৌড় কদ্দুর!!!”
ভাইরে তর্কের মধ্যে যাওয়ার টাইম নাই। আপনি নিজেও খুব ভাল করে জানেন “বিড়ি খাওয়ার ফজিলত“। এই ফজিলতের কারণেই আপনি আপনার বাবার সামনে বিড়ি ধরান না। আপনি নিজে খোর হওয়া সত্ত্বেও আপনার ছোট ভাইয়ের শার্টে বিড়ির গন্ধ পাইলে তার ছাল–বাকলা ঠিকই তুলে নেন। আপনার সন্তান বিড়ির দিকে হাত বাড়ালে তাকে ‘জম্মের শিক্ষা‘ দিয়ে থাকেন। আপনি নিজে বিড়িখোর হলে এর pros cons আপনি খুব ভাল করেই জানেন। টেনশন দূর করতে নামাজ বা ধর্মীয় প্রার্থনা না করে বিড়িতে টান দিতে হবে এই শিক্ষাটা কোথা থেকে আসছে জানি না, তবে কিছুটা দায় হয়ত নাটক–সিনেমারও নিতে হবে। যারা রাজকীয় ভঙ্গিতে হুক্কা–বিড়ি টানার দৃশ্য দেখায় আর নিচে স্টার চিহ্ন দিয়ে ছোট করে লেখে তামাশা বাক্য “ধুমপান মৃত্যু ঘটায়“।
একটা থিসিস হতে পারে এই টপিকের উপর “মিডিয়ার কারণে উৎসাহিত হয়ে ধুমপায়ী হবার সম্ভাবনা“।
——
কমার্স কলেজের বা রাজউকের পিচ্চিগুলা রাস্তায় দাঁড়ায়ে বিবাহের প্রস্তাব (!) দেয়। খুবই চমৎকার বিষয়! এতই চমৎকার বিষয় যে কলেজ থেকে টিসি খাওয়া লাগে। এখন আবার একদল আমাকে জ্ঞান দিবে “ওদের প্রেম তো একেবারে স্বর্গ থেকে আগমন করেছে। ওরা তো খারাপ কিছু করে নাই। তুই একটা প্রতিকৃয়াশীল! তুই রাজাকার!”
এইখানেও একই কথা। তর্ক করার টাইম নাই। ম্যালা কাজকর্ম পড়ে আছে। খারাপ ভালর স্ট্যান্ডার্ড অবশ্য একেক জনের কাছে একেক রকম। রাস্তায় পরম ভালবাসায় জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করা আর চুমু দেয়ার কালচার আপনার সত্যি পজিটিভ মনে হয়? শুধু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সাথে চলা ঐ ভিডিওটাতেই পজিটিভ মনে হয় নাকি আপনার ছোট ভাই, ছোট বোন, আপনার সন্তানের ক্ষেত্রেও পজিটিভ মনে হয়? তর্কের খাতিরে অনেকেই বলবে “এতে তো কোন দোষ নাই। প্রাপ্ত বয়ষ্ক ২ জন মানুষ রাস্তায় সেমি পশুসুলভ আচরণ করতেই পারে। আমার ভাই–বোন–সন্তান এমন করলেও আমি মেনে নিব“। তাহলে বলব এই পোস্ট পড়ে আপনার সময় নষ্ট করার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। তা যদি না হয় তাহলে বাকি অংশ পড়তে পারেন।
—–
আপনি বাসায় ফিল্টার করা ছাড়াই মুভি–সিনেমা–সিরিয়াল দেখে যাচ্ছেন। নাটককে বলা হয় সমাজের দর্পণ। তবে আমাদের দেশের ক্ষেত্রে দেখি এই দর্পণ খালি এক দিকেই তাক করা থাকে। প্রেম–ভালবাসা–পরকীয়া ছাড়া সমাজে আর কিছুই নাই। যেই বুদ্ধিজীবিরা (!) এই শীটি প্রোডাক্টগুলো বানায় তারা জীবনে সত্যজিৎ রায়ের মুভিগুলো দেখে স্টাডি করেছে কিনা সন্দেহ। আইডিয়ার এতই অভাব? বাসন মাজার ছাই, শেভিং ক্রিম, শিশু খাদ্য থেকে শুরু করে যে কোন প্রোডাক্টের বিজ্ঞাপন দেখলে খালি সেই “খাজ কাটা, খাজ কাটা, খাজ কাটা…”র গল্পের কথা মনে পড়ে। বিজ্ঞাপনের বিষয়বস্তু কি প্রোডাক্ট নাকি নারী? নাকি নারীই প্রোডাক্ট? থাক আর না বলি… নারীর স্বাধীনতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এসবের মাধ্যমে। দূর্ণাম করলে গালি খাওয়া লাগবে আবার!
আপনার সন্তানদের সামনে এগুলো খুলে দিয়ে রাখছেন। ৪–৫ এ পড়া স্টুডেন্টরা এখন সামওয়ানকে মিস করা শুরু করে। ওরাও শিখে গেছে মনের কথা শেয়ার করার জন্য একজনকে দরকার। ফোর–ফাইভে পড়া ছোট্ট রাতুলকে ক্লাসের ছেলেপুলেরা সমবেদনা জানায় একই ক্লাসের শীলামণি ঐদিন ক্লাসে এবসেন্ট থাকায়। রাতুল বাবুর এতে মনের কষ্ট আরো বেড়ে যায়। যে সময় মিমি চকলেটের জন্য কান্নাকাটি করার কথা তখন রাতুলের বুকে হাহাকার বোধ হচ্ছে বিপরীত লিঙ্গের একটি মানুষের জন্য। যদিও তার লিঙ্গে একনো পৌরুষ এসে পৌঁছায় নি।
—
শ্রদ্ধেয় সন্তানের মা জননীরা…
আপনি অনেক বড় ডিগ্রী নিয়েছেন। তাই সংসারের হেঁসেল ঠেলে লাইফ ওয়েস্ট করতে চাচ্ছেন না। আপনার মনে প্রশ্ন আসে “মাস্টার্স করেছি কি ঘরে বসে থাকার জন্য?” ঘরে কি আপনি আসলেই বসে থাকবেন? নাকি একটি সভ্যতার লালন করবেন? সভ্য জাতির একজন সদস্য তৈরি করা আপনার কাছে লাইফ ওয়েস্ট মনে হচ্ছে? আপনি যেভাবে তাকে বেড়ে তুলতে পারবেন কাজের লোক বা অন্য আত্মীয়েরা কি সেভাবে পারবে? আপনি এত আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে কেন ভুগেন, যে আপনার মনে হয় আপনার পরিচয় দেয়ার জন্য কোন জবে কোন পজিশনে আছেন সেটা বলাটা ম্যান্ডেটরি? গৃহিনী হওয়াটাকে আপনারা স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলে মনে করেন কেন আসলে? হাজব্যান্ড যদি সংসার চালাতে পারে, তাও একজন মেয়ের কিছু করা উচিত। আসলে এটা কেন? একজনের উপার্জনে সংসার না চললে দুইজন চেষ্টা করবে। এটাই স্বাভাবিক না? এখন শুনি ধারণা চেঞ্জ হয়েছে। একজন মেয়ে নাকি শুধু টাকার জন্য জবে ঢুকে না। জবে না ঢুকলে নাকি তার অধিকার–স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয় না। নিজের বাড়িতে থেকে ঘরটাকে স্বর্গ বানানোর চেষ্টা করার মানেই এখন ‘মেয়েদেরকে ঘরে বন্দী‘ করার নামান্তর!
আমার আম্মু BA পাস করা। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট নিয়ে তিনি সারা জীবন “নষ্ট করেছেন” আমাদেরকে সভ্য মানুষ হিসেবে বড় করার জন্য। আমরা এ জন্য কৃতজ্ঞ। তিনি খুব ভাল একটা জবে ঢুকে যেতে পারতেন। আমাদের সংসারে যে টানাপোড়েন ছিল সেটা হয়ত কখনোই থাকত না। হাই প্রোফাইল নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় শো অফ করতে পারতেন ‘আমি অমুক! আমি তমুক!’ বলে। কিন্তু তাহলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হতাম আমি। আমি আল্লাহর রহমতে শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা ও আরবি পড়তে পারি। বাংলা পড়ার পুরো কৃতিত্ব আম্মুর। আরবিটা শিখেছি মাদরাসা থেকে। মাদরাসা থেকে ব্যাক করে আমি আবার আম্মুকে আরবি শিখিয়েছি। শুধু গৃহশিক্ষক বা স্কুল থেকে খুব বেশি শেখার সুযোগ আসলেই নাই। স্কুলে কয়েক ঘন্টা সময় পাওয়া যায় মাত্র। কিন্তু বাকিটা সময় আম্মুর সাথে থাকার সুযোগ হওয়ায় তাঁর জানা পজেটিভ সকল বিষয়ে প্র্যাক্টিস হয়েছে সেই ছোট্ট বেলা থেকেই।
মায়েদের চাকরি করতে ঢালাও ভাবে নিরুৎসাহিত করছি ব্যাপারটা এমন না। সংসারের প্রয়োজনে মায়েরা জব করতেই পারেন। এতে তাদের পরিশ্রমের পরিমাণটা হয় দ্বিগুণ! আমি নিজের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করি যেন আল্লাহ আমাকে এতটুকু রিযিক অন্তত উপার্জনের সুযোগ করে দেন যেন আমার অর্ধাঙ্গীকে রিযিকের খোজে বাইরে বের হতে না হয়।
—-
লেখা শুরু করেছিলাম একটা টোনে। টোন চেঞ্জ হয়ে গেল শেষ পর্যন্ত আসতে আসতে। জানি কোনোও লাভ নাই এইসব লেখার। কিন্তু ঈমানের ৩টা স্তর আছে। শক্তি প্রয়োগ করে খারাপ কাজকে বন্ধ করা, না পারলে কথা বলে বন্ধ করার চেষ্টা করা, সেটাও না পারলে অন্তরে ঘৃণা করা ও মনে মনে পরিকল্পনা করা কিভাবে বন্ধ করা যায়। দ্বিতীয় স্তরের ঈমানের পরিচয় দিচ্ছি।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনের লোকজনের অন্তরে যদি কিছু পরিবর্তন আসত! বস্তা পচা বোগাস সব আইডিয়া নিয়ে কাজ করা বাদ দিয়ে প্রোডাক্টিভ কিছু যদি করত। শৈল্পিক ভাবে, শিল্পগুণ অক্ষুণ্ণ রেখেও তো সমাজের জন্য কাজ করা যায়। নাটক–সিনেমায় তো সমাজের প্রতিফলন বা যেটা হওয়া উচিত সেটা দেখানোর কথা। যেই বস্তা পচা প্রেম কাহিনী দেখানো হয় সেটা কি আদৌ সোসাইটিকে রিপ্রেজেন্ট করে? নাকি তেনাদের ইচ্ছা এগুলোর ইফেক্ট সমাজের উপর পড়ুক। যদি সেটাই ইচ্ছা হয় তাহলে বলতে হবে তারা সফল। আকাশ সংস্কৃতির আমদামী করে বাচ্চাদের দেহে যৌবন আসার আগেই মনে যৌবন নিয়ে আসা হচ্ছে। দোষ আসলে যারা বানাচ্ছে তাদের না। তারা হয়ত বানাচ্ছে বাচ্চার বাপ–মায়ের জন্য। বাপ–মা যদি প্রাইভেসি মেইনটেইন করতে না পারে তাহলে এর দায় তো তাদেরই উপর পড়বে।
খুব ভয়ংকর, বিষাক্ত, দুর্নীতিগ্রস্থ, অনৈতিক আর অসুস্থ্য একটা সময়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। খুব খুব খুব…